www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বিশ বছর পর চিঠিটি পড়বে

##

আরো দশ বছর।

আরো দশ বছর পর- “বিশ বছর পর চিঠিটি পড়বে” শিরোনামে তামাটে খস খসে খামে যে চিঠিটি দেওয়া আছে তা তন্ময় পড়তে পারবে। চিঠিটির দাত্রী হিয়া এমন ভাবেই বলে গিয়েছিলো । সে অনুযায়ী চিঠিটির আজ দশ বছর পূর্ণ বা দশম জন্মদিন, আবার অন্য ভাবে চিঠিটির দশম অপেক্ষিত মৃত্যুবার্ষিক !

তন্ময় প্রতি বছর এইদিনে চিঠিটির খাম হাতে একবার নিয়ে নাড়া চাড়া করে আবার যেখান থেকে নিয়ে থাকে সেখানেই রেখে দেয়। উৎযাপন বলতে এইটুকুই । তার বেশি কিছু না । প্রথম কয়েক বছর অনেক ভাবতো তন্ময়- কি লেখা থাকতে পারে, কি কি উপদেশ বানী থাকতে পারে, কি রকম আবেগ থাকবে, কি কি বলবে চিঠিটির মূলপ্রতিপাদ্য- ইত্যাদি ইত্যাদি- কতো কি হতে পারে ! বেশ মোটা একটা খামে অন্য কিছু কি আছে? এই ছোট্ট কথা ভেবে অনেক রাত কাটিয়ে দিয়েছে সে। ধীরে ধীরে জীবনের ব্যস্ততা কমিয়ে দিয়েছে ভাবনা গুলো, তবে স্মৃতির সাথে প্রতারনা করতে না পেরে, চিঠির ভাবনা থেকে মুক্তি পেয়েও মুক্তি মিলে নি বলেই হয়ত প্রতি বছরের ন্যায় আজো চিঠিটির দশম প্রাপ্তি বার্ষিক উৎযাপন করছে। তন্ময় মাঝে মাঝে ভাবে, সে কি আসলেই অপেক্ষা করছে এই চিঠির জন্য? নাকি অপেক্ষাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে? এই দ্বন্দ্ব তন্ময়ের মাঝে চললেও তন্ময় তাকিয়ে আছে চিঠি হাতে পাওয়া থেকে বিশ বছর পর সে চিঠিটি খুলছে এবং দুচোখ ভিজাচ্ছে চিঠিটি পড়তে পড়তে ।

##

হিয়া ছিলো সাধারন একটা মেয়ে, তন্ময়ও ছিলো সাধারন একটা ছেলে, কিন্তু তারা চেয়েছিলো অসাধারন কিছু করতে, তবে তাদের অসাধারন কিছু করা হয়ে উঠেছিলো কিনা জানা না থাকলেও তাদের শুরুটা হয়েছিলো অতি সাধারন ঘটনার চেয়ে সাধারন হিসেবে।

তাদের দেখা হয়েছিলো গ্রীষ্মের একটা দিনে, যেদিন দুইজনই গরমে ঘামছিলো। তন্ময় হিয়াকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাঙ্গণে দেখে পছন্দ করেছিলো, আর সেটাকে আরো একটু এগিয়ে নিতে হিয়ার সাথে কথা বলার বিভিন্ন মাধ্যমে খুজছিলো। সবাই যেমন এইসব বিষয়ে কোন না কোন উপায় পেয়ে যায় তেমনি তন্ময়ও পেয়েগিয়েছিলো। মাধ্যম ব্যবহার করে হিয়ার সাথে স্বাভাবিক ভাবে পরিচিত হয়। পরিচিত হওয়ার পর মাঝে মাঝে কথা হতো দুইজনের, তবে কথা গুলো হতো গতানুগতিক, কারন কারো মনে তখনো কিছু দানা বাঁধার উদ্দেশ্য ছিলো না। তন্ময় হিয়াকে পছন্দ করেছিলো ঠিকই, তবে এমন পছন্দ অনেকেই করে তাদের সাথে আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে যেত । তাই বরাবরের মতো একে পরিণতির উদ্দেশ্যে পরিচিতি বলা যায় না। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যেতে না যেতেই তন্ময় এবং হিয়ার মধ্যে নতুন গল্প জন্ম নিলো।

কথা বলতে বলতে আর মাঝে মাঝে দেখা হতে হতে তন্ময়ের মাঝে হঠাৎ উপলব্ধি এলো হিয়া মেয়েটি চমৎকার; এই মেয়েটির সাথে অনেক দূর পর্যন্ত পথে হাটা যায়। বৃষ্টির দিনে যেমন, ঝড়ের দিনেও তেমনি, তেমনি আবার যায় ঠা-ঠা রোদে ছাতা মাথায়। তন্ময়ের মাঝে হিয়ার প্রতি দৃষ্টি পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে উঠছিলো। সে হিয়াকে দেখিয়ে অনেক কাজ করার বাসনা না থাকলেও করে ফেলতো । মিথ্যার কিছু আশ্রয় না থাকলেও ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা যায় শুধু মাত্র প্রিয়মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছার মান দ্বন্দ্ব দিয়ে। অপর দিকে হিয়া কিছুটা টের পেয়েও নিশ্চুপ থেকে ছিলো। সে বুঝতে শুরু করলেও ব্যাপারটা তাকে ছুয়ে যেতে পারছিলো না। জীবনটা অনেক কঠিন হিসাবের যায়গা, এই যায়গাতে হিয়ার উপলব্দি ভীষণ কড়া যেটা তার দম্ভ হিসাবে ছিলো। তাই সে এটাকেই পুজি করে যেমন চলছে- চলুক প্রথাতে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তন্ময় প্রথমে নিজের মধ্যে, তারপর বন্ধুবান্ধব, সর্বশেষে পরিবারের সবচেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষীর ভালো মন্দ পরামর্শগুলো নিয়ে হিয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। যেহেতু ভালোবাসাতে জুয়ার অভাব হয় না, কার তাস কার দিকে চলে যায়- সেহেতু তন্ময় তাড়াহুড়া হোক বা সঠিক সময় হোক- এইসব না বুঝেই হিয়াকে প্রোপজ করার কথা ভেবে বসেছিলো। দিনক্ষন ঠিক করে, সাহস করে তা করেও ফেললো ফেললো করে যেদিন করবে তার আগের দিন যখন কিছুটা ঝলকে হিয়া বুঝে গেলো তন্ময় তাকে প্রোপজ করতে চাচ্ছে তখন সে তন্ময়কে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছিল এমন কিছু করে থাকলে সে এই রকম সম্পর্ক মেনে নিবে না । এই মতের বিপরীতে তন্ময়ের সামনে নতুন কিছু খুজে বের করার পথ ভাসচ্ছিলো। গুছিয়ে এনে সব ভেস্তে গেলে যেমন অনুভূতির কথা তন্ময় আগে যা শুনেছিলো সেদিন তার সামনে নিজের অনুভূতিতে দেখতে পেয়েছিলো । অপর দিকে হিয়া যেন কিছুটা মুক্তি ভালো বোধ করেছিলো এই ভেবে, একটা ছেলেকে পুরোপুরি প্রোপজের পর না বলার পরিস্থিতিতে না ফেলে।

এই ঘটনার ফলাফলে দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিলো দু’জনের, আর তাদের নিজেদের কথা বলার মধ্যে আবেগের কমতি দেখা দিচ্ছিলো। এই ব্যাপারটা হিয়ার চোখে প্রথমে নাড়া ফেলেছিলো। সে ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে প্রথমে মেনে নিলেও পরে বুঝতে পারে তন্ময়ের আবেগময় বন্ধুত্বটাকে সে অনেক বেশি চায়, চাচ্ছে। তার মনে বারবার পূর্বের স্মৃতিগুলো আসছিলো আর বারবারই সেটা ফিরে পেতে চাচ্ছিলো। সে যেন ধীরে ধীরে বলতে চাচ্ছিলো তন্ময়ের সাথে সেও পথ চলতে চায়। কিন্তু দেরি কি হয়ে গেছে অনেক? হিয়া চেষ্টা করা শুরু করেছিলো, তবে মেয়েরা রীতি অনুযায়ী যেভাবে নিজেদের পুরোটা উন্মুক্ত না করে সেভাবে হিয়া করার চেষ্টা করেছিলো। তন্ময় যেন ব্যাপারটা ধরতে পারচ্ছিলো না। আগের মতোই সাধারন আর ভয় মিশেল একটা সন্মানসূচক দূরত্ব বজায় রেখে চলছিলো। হিয়ার প্রতি তার দূর্বলতা সর্বকালের- সে কারনে হিয়ার প্রতি সন্মান বোধটাকে বেশি কাজে লাগাতে গিয়ে আবেগকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিলো। হিয়ার চাওয়াটাকে সে তখন ভিন্ন স্বরে শুনতে পেতো। বন্ধুত্ব বেড়ে চলছিলো দূরত্ব রেখে, তবে হিয়ার গতিবিধি উল্টো দিকে শুরু হলো- তন্ময়ের শুরুর দিকের দিকে, অপর দিকে হিয়ার শুরুর দিকের দিকে তন্ময়ের। পরিশেষে তন্ময়ের দিক দিয়ে বন্ধুত্ব এবং দূরত্ব সমান তালে বাড়ছিলো, আর হিয়ার দিক দিয়ে বন্ধুত্ব বেড়ে দূরত্ব কমছিলো। ততোদিনে তন্ময় নিজের মনের মতো কাওকে খুজে না পেয়ে, পিতা-মাতার পছন্দ করা মেয়েকে জীবনের সাথী, পথের ভাগিদার হিসাবে গ্রহণ করেছিলো যেমনটা বাঙ্গালীর প্রায় ঘরে ঘটে থাকে। হিয়ার এই ব্যাপারটা সহ্য হচ্ছিলো না। আর মনের কোন এক অংশে বারবার আঘাত হানছিলো হাতুড়ি পেটার মতো করে। হিয়ার যেন কিছুই বলার ছিলো না! তন্ময়ও কিছু বলতে পারচ্ছিলো না, বন্ধুত্বের সন্মান নষ্ট হয়ে যাবে বলে। প্রিয় মানুষের প্রতি এইটুকু অক্ষত রেখে জীবন চালানোর সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিলো শেষ পর্যন্ত। সময়, ঘটনা এগিয়ে চলছিলো, যা হওয়ার তাই হচ্ছিলো। এরই মাঝে হিয়ার চাকরির জন্য শারীরিক চাপ, তন্ময়ের প্রতি ভালোবাসা এবং তার সাথে পূর্ন জীবন বিচ্ছেদময় অপমান আর বিয়ে কেন হচ্ছে না- এই সব মিলে পচা বাসী খিচুড়ি তার প্রাণভ্রমরকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিলো। হিয়ার জীবনে শরীর অবক্ষয় , ভেঙ্গে পড়া শব্দগুলো যোগ হচ্ছিলো, যেমনটা তার মনে জমতে থাকা কথা গুলো নীল খামের চিঠির পাতায় অজ্ঞাত শব্দে ভরছিলো। একটা সময় সেই নীল খামের চিঠির শব্দ ফুরিয়ে গিয়ে নীল খামে বন্দী হয়েছিলো বিশ বছরের জন্য, সমান্তরাল ভাবে হিয়ার এই পরিবেশে থাকার আয়ু কমে আসচ্ছিলো। হিয়া বুঝতে পেরেছিলো এখানে থাকলে তার সব দিক দিয়ে ক্ষতি, শারীরিক, মানুষিক, তাই সে বিদেশ চলে যাওয়ার মতলব করছিলো। কিছুদিনের মধ্যে সে ব্যাবস্থা করে ফেলেছিলো। হিয়া তার মা-বাবাকে নিয়ে চলেও গেলো বিদেশে। যাওয়ার পর সবার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো পুরোপুরি; হিয়া মনে মনে এটাই চাচ্ছিলো। শুধু যাওয়ার আগে তামাটে খস খসে খামের চিঠিটি তন্ময়কে নিশ্চিত ভাবে পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলো।

তন্ময়ের কাছে ব্যাপারটা শীতল অনুভূতির মতো লাগছিলো। সে বুঝে গিয়েছিলো বিশাল এক ভার তার বইয়ে নিয়ে যেতে হবে- আবেগ, ভালোবাসার নিশ্চুপ আর্তনাদ নিয়ে, যা সময়ের সাথে কমে আসলেও নির্মূল হবে না কোনদিন; অন্তত বিশ বছর পর পড়বে চিঠিটি’র পড়া না পর্যন্ত।

শেষ
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৮৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৫/১০/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast