www.tarunyo.com

ঝিলিক

ম্যাট্রিক এ জি.পি.এ. ফাইভ পেয়ে উর্ত্তিন্ন হল, বেড়ামালিয়া গ্রামের একটি মেয়ে যার নাম “ঝিলিক”। ও পার্শ্বস্থ শালখুরিয়া গ্রামের সাধারন স্কুলে পড়াশোনা করেছে, তাই হয়তবা গোল্ডেনটা পায়নি। কিন্তু সে আর ভুল করতে চায়না। তাই সে পরবর্র্তী পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়ে গেল বিরামপুর ডিগ্রী কলেজে। যেটার অবস্থান সেই গ্রাম থেকে প্রায় ১০ কিঃ মিঃ পশ্চিমে।


বেড়ামালিয়ায় তার নানা-নানীর বাসা। তার বাবা-মা দুইজনেই দিনাজপুর শহরে চাকুরীরত। তারা সেখানে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। দুইজনেই চাকুরী করে, তাই তারা ঝিলিকের ঠিকমত কেয়ার করতে পারবে বলে, তাকে তার নানার বাসায় রেখে লেখাপড়া করাচ্ছে। তার নানার নাম “জনাব মইনুল সাহেব”। ১৫০ বিঘা সম্মপ্তির মালিক। পানি সেচের দ্বিপ, ব্যাবসা-বানিজ্য এসব মিলে আশেপাশের কয়েকটা গ্রামের মধ্যে তিনিই বেশী সম্ভ্রান্তশীল। আর তাদের সেই পরিবারের যতটুকু শান্তি ছিল, তার মধ্যমণি ছিল “ঝিলিক”।

মইনুল সাহেব বাড়ীতে আসলে যদি ঝিলিককে না পায়, তাহলেই বকবকানি শুরু করে দেবে। আর শুধু প্রশ্ন করবে, সে কোথায় গেছে, কেন গেছে, কার সঙ্গে গেছে, কখন আসবে, এসবকিছু। যে যে উত্তরগুলো দেবে সে হয়তবা অস্থির হয়ে উঠতে পারে কিন্তু ঝিলিকের বিষয়ে প্রশ্ন করতে তিনি কখনই যেন অস্থির হন না। তাই কলে ওনার বয়স কিন্তু কম না। সত্তের এরও বেশী। এমন বয়সেও ওনাকে অনেকরকম কাজ করতে হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরেন, ছেলের দোকানে বসেন, চাষাবাদের কাজ সামাল দেন, গ্রামের মানুষ সমস্যায় পড়লে তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন। এতসবের মধ্যেও একটিবারের জন্য ঝিলিককে ভুলে থাকতে পারেন না।

ওনার আরেক মেয়ে ঢাকায় থাকেন যার এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুই মেয়ে ব্যাতিত সন্তান বলতে আর একজন ছেলে হিরন সাহেব যিনি পার্শ্বস্থ দলারদরগা বাজারে বড় রকমের একটি মুদিখানার দোকান করেন। ওনার জীবনটাও কষ্টময়। বিয়ের কিছুদিন পরই ওনার স্ত্রী স্বাভাবিকভাকে ইন্তেকাল করেন। এরপর ২য় বিয়ে করেছেন পাচঁ বৎসর হল কিন্তু এখনও কোন সন্তান হয়নি। আর তাই হয়তবা ঝিলিক ১৭ বৎসরে পদার্পন করেও, ছোট বাচ্চার মত এখনও আদুরে।

যাই হোক, এখন সেই আদুরে মেয়েটির কথা বলি, যে প্রতিদিন বাসে চড়ে বিরামপুরে যাতায়াত করে, কলেজের ক্লাশ করার জন্য। তার নানী তাকে প্রতিদিন সকাল ৮টার মধ্যে খাবার প্রস্তুত করে দেন। তার সেই নানী আজ বাসায় নেই, ওনার মেয়ের বাসাতে বেড়াতে গেছেন। তাই বলে ঝিলিকের মায়ের বাসায় নয়, ঝিলিকের খালার বাসায় যিনি ঢাকায় থাকনে। আর ঝিলিকের মামী ওনার বাবার বাড়ীতে গেছেন। আজই বিকেলে ফিরে আসবার কথা। সকালবেলা মইনুল সাহেব ঝিলিককে একটি একশত টাকার নোট দিয়ে বললেন, “আজ বাহিরে খেয়ে নিও।” ঝিলিক বলল,“খাবার তো রান্না করায় আছে।” তার নানা প্রতিউত্তরে বললেন,“ঠান্ডা খাবার তোমার খেতে হবেনা। কোন হোটেলে খেয়ে নিও।” ঝিলিক তখন টাকাটা নিয়ে বলল,“আচ্ছা ঠিকআছে।”

এর কিছুক্ষনের মধ্যেই ঝিলিক কলেজে যাবার জন্য প্রস্তুত। বাড়ী থেকে বের হয়ে দেখল, প্রচন্ড কুয়াশা। তখন হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ৮টা বেজে কুড়ি মিনিট কিন্তু এমন সময়েও আশেপাশে মানুষজন নেই। হয়তবা সকলে লেপ-কম্বলের মধ্য থেকে তখনও ঘুমোচ্ছে। তিব্র কুয়াশার জন্য অনেকের দৈনন্দিন রুটিনটা পরিবর্তীত হয়েছে কিন্তু ঝিলিকের রুটিন কখনও পরিবর্তীত হয়নি পরিবর্তন হয়না। প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন, সময়ের কাজ সময়ে। তাই আজও প্রতিদিনের মত কলেজে যেতে হচ্ছে তাকে। সামনে দলার দরগা বাজার। সেখানে গিয়ে তাকে বাস ধরতে হবে। তারপর সোঁ করে একেবারে কলেজের গেটের সামনে। কিন্তু দলারদরগা বাজার প্রর্যন্ত তাকে প্রায় ১০ মিনিট হেটে যেতে হবে। এত কুয়াশার মধ্যে রিক্সা-ভ্যান পাওয়া দুষ্কর।

হেটে হেটে পথ চলতে থাকাকালিন, ফুল ফোঁটা শিউলি গাছের নিচে ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলের মাঝে দেখতে পেল, একটি টিয়ে পাখির বাচ্চা। এ সময় তার হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল, ছোট্টবেলার সেই দিনগুলোর কথা। যখন মাঝে মাঝে বাড়ীর আনাচে-কানাচে, ঝোপে-ঝাড়ে, গাছে-গাছে, টিয়ে পাখীর বাসা খুঁজে বেড়াত। সেখানে পাখীর বাচ্চা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। টিয়ে পাখীর বাচ্চা পেলে পুষবে, বুলি শিখাবে। সেটা তার শুধুই ছোট্ট বেলার চেতনা, নতুবা আজকে পাখীর বাচ্চাটি আর শিউলীর তলায় পড়ে থাকত না। হয়তবা সেটাকে তুলে নিত, বন্ধুদের দেখাত। আনন্দে আজকে ক্লাশেই যেত না। কিন্তু কেন জানি ঝিলিকের সেই ছোট্ট বেলার দিনগুলোর কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে গেল। তার মন চাইল যেন সেইদিনের মতকরেই আজকের দিনটি পালন করি। কতনা আনন্দে কেটেছিল ঐ ছোট্টবেলার দিনগুলো ! নতুবা সেসব কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে কেন ? এসব প্রশ্ন জেগে উঠল, ঝিলিকের অন্তরে। আবার ক্ষনিকের মধ্যই তার মাথাটা নাড়া দিয়ে বলে উঠল, “তুই সেই দিনের সেই ঝিলিক আর আজকের এই দিনের এই ঝিলিক নয়। তুই এখন স্কুল ছেড়ে কলেজে পরিস। আজকে অনেককিছু জানিস ও বুঝিস। এসব জেনে, এসব বুঝে, তোর আর এখন সময় নষ্ট করা যাবেনা। তোকে এখন বাজারে যেতে হবে, নাস্তা করতে হবে, তারপর কলেজে যেতে হবে।”

এই ভেবে আবার পথ চলতে থাকল ঝিলিক। একটু সামনে গিয়ে দেখা হল, তার একজন ভালো বন্ধু মোকাররমের সাথে। মোকাররম তাকে অনেক ভালবাসে। এ প্রর্যন্ত শুধু একটি মেয়েকে নিয়েই ভেবেছে, সেই হচ্ছে ঝিলিক। সে প্রতীক্ষার রাস্তায় বসে আছে অবিরাম, কখন সে এসে ধরা দেবে তার হৃদয় পিঞ্জরে। মোকাররম দিনাজপুর পলিটেকনিক্যালে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এ কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে পড়তেছে। সেও খুব ভালো ছাত্র। তাকে প্রথম শ্রেনীর ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। এটা শুধু তার ইচ্ছা নয়, দৃঢ় প্রত্যয়।

মোকাররম বাড়ীতে আসছে সে খবর ঝিলিক শুনেছে তবে আসার পর থেকে তার সাথে এখনও দেখা হয়নি। দেখা করার ইচ্ছা তো মোকাররমেরই বেশী হবার কথা কিন্তু সে ঝিলিকের বাড়ীর আশেপাশে যেতে পারে না। লজ্জা লাগে না ভয় লাগে, সেটা সেই ভালো জানে। আর আজ যখন মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল তাতে আর দুটো কথা না বললেই বা কেমন হয় ? তবে প্রথমে ঝিলিকই বললঃ
ঝিঃ কেমন আছিস ?
মোঃ একটু একটু খারাপ ছিলাম ; এখন ভাল।
ঝিঃ কেন ? আমার সঙ্গে দেখা হল, তাই ?
মোঃ তুই তো সবই বুঝিস।
ঝিঃ তো, তোর সঙ্গে এভাবে দেখা হল ! তুই কুয়াশার মাঝে, বাহিরে বের হয়েছিস কেন ?
মোঃ তোকে দেখব বলে তাই।
ঝিঃ তুই কিভাবে জানলি, আমি এখন এই রাস্তা দিয়ে হেটে যাব ?
মোঃ আমার মন বলল তাই।
ঝিঃ তোর মন আগে থেকেই বলতে পারে !
মোঃ হ্যাঁ ; আগে থেকেই আরো অনেক কিছু বলতে পারে।
ঝিঃ আর কি বলতে পারে শুনি।
মোঃ আমার মন বলে, তুই চিরদিন আমার পার্শ্বেই থাকবি।
ঝিঃ যদি না থাকি ?
মোঃ আমি যে থাকতে পারব না।
ঝিঃ তাহলে, তোর কথা আল্লাহ্ যেন পূর্ণ করে।
এ কথা শুনে মোকাররম একটু আনন্দময়ী উচ্চকণ্ঠে বললঃ
মোঃ ইয়া..হু...!!! তার মানে তুই রাজী ?
ঝিঃ আরে না। আমি সে কথা বলছি না। মনে কর, আমি ঝিলিক না। অন্য একটা মেয়ে। এখন তোর দিকে চেয়ে আমি বলতেছি, “তোর কামনা যেন পূর্ণ হয়।” কিন্তু আমি আবার ঝিলিক হয়ে বলব, “আমি তোর কামনা কখনই পূর্ণ করবনা।”
মঃ এভাবে বলিস না রে। কষ্ট লাগে রে,কষ্ট লাগে।
ঝিঃ আমার কিছুই করার নাই। আমাকে এভাবেই বলতে হবে।
একথা শুনে মোকাররম আর সামনের দিকে না এগিয়ে পিছন দিকে হাটতে আরম্ভ করল। এরপর একটু সজোরে বললঃ
মোঃ তাহলে আমি আর তোর সাথে হাটব না। তোর সাথে কথাও বলব না।
ঝিঃ আচ্ছা ঠিক আছে। তাই করিস।
মোঃ এই না। এর পরেও আমি তোর সাথে দেখা করব, কথা বলব, একসাথে হাটব, সবকিছু করব।

একথা শুনে ঝিলিকের হাসি পেল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘনিয়ে আসল তার হেটে চলার পথ। দলার দরগা বাজারে পৌছিলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ৮ টা বেজে ৪০ মিনিট। আজকে দশ মিনিটের রাস্তাটা অতিক্রম করতে কুড়ি মিনিট সময় ব্যয় করেছে। এরপর ঝিলিক একটি দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। সেই দোকানদারটার সঙ্গে ঝিলিকের কিছু কথোপকথোন হচ্ছিল।
দোঃ কি ব্যাপার ঝিলিক ? আজকে এত আগে যে ?
ঝিঃ আঙ্কেল, কিছু খাইনি তো। বাহিরে কিছু খেতে হবে, তাই।
দোকানদারটি একটি হোটেল দেখিয়ে দিয়ে বললঃ
দোঃ এই হোটেলে খেয়ে নাও।
ঝিঃ না থাক ; বিরামপুরে গিয়ে খাব।
দোঃ তাহলে দশ মিনিট আগে আসলেই তো একটি বাস পেতে।
ঝিঃ এরপর আর....
দোঃ এরপর ৯ টা ৩০ মিনিটে। তুমি যেটাতে প্রতিদিন যাও।

ঝিলিক সেখানে বসে বসে, মোকাররমের সাথে বলা সেই কথাগুলো স্বরণ করল। তখন মোকাররম বলছিল, “আমার মনে হয়, তুই চিরদিন আমার পার্শ্বেই থাকবি”। এসময় ঝিলিক বলছিল, “আমি যদি না থাকি?” এরপর মোকাররম বলছিল “আমি যে থাকতে পারব না”। একথা স্বরণ করতেই ঝিলিক মনে মনে বলল, “তোকে ছাড়া আমারও থাকতে কষ্ট হয়। কিন্তু নানু তো চাইছে না যে তোর সাথে আমার সম্পর্কটা হোক।

এর কিছুক্ষন পর সেখানে টেক্সি অনুরুপি তিন চাকা ওয়ালা একটি গাড়ী আসল যেটা প্রেটোল কিংবা ডিজেল চালিত। সেটাকে সেইদিকের ভাষায় বলা হয় টেম্পু। বাস ব্যাতিত হাই রোডে পরিবহনের জন্য সেটিই একমাত্র ভরসা কারণ, সি.এন.জি. ফিলিং ষ্টেশনের অভাবে সি.এন.জি. চালিত ট্যাক্সি সেদিকে নেই। তবে যাই হোক, ঝিলিক এখন এই গাড়ীতেই উঠবে কারণ সাড়ে নয়টার বাসে করে গেলে সে বিরামপুরে নাস্তা করার মত আর সময় পাবেনা। যাবার সময় দোকানদারকে বললঃ
ঝিঃ আঙ্কেল থাকেন। আমি এইটাতেই যাই।
দোকানদারটি খুব মায়াবি একটা সুরে বললঃ
দোঃ ঠিক আছে মা যাও।

ঝিলিকের এতক্ষণে টেম্পুতে ওঠা হয়ে গেছে। গাড়ীটি এখন টো-টো করে বিরামপুরের দিকে পাড়ি দিচ্ছে। আর এদিকে মইনুল সাহেব বাড়ীর আঙ্গিনায় রৌদ্রে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। এমন সময় ঘর থেকে ভেসে আসল মোবাইল ফোনের রিং টোনের শব্দ। তখন তিনি ঘরে প্রবেশ করে কলটি রিসিভ করে বললেনঃ
মঃ হ্যালো....
ওনার স্ত্রী বললেনঃ
ম-স্ত্রীঃ হিরনের আব্বা ?
মঃ হয়। তুই ক্যাংকা আছিস ?
ম-স্ত্রীঃ ভালো।
মঃ বাড়ীর ছলেরা ভালো আছে ?
ম-স্ত্রীঃ হয়, সবাই ভালো। তে হছে, কাজের বুয়া আইছে ?
মঃ না-না লাগবলাই তো। আজকাই বৌমা আসপি।
ম-স্ত্রীঃ ঝিলিক কোটে ?
মঃ কলেজে গেইছে।
ম-স্ত্রীঃ কি খাইছে ?
মঃ হোটেলে খাওয়ার তনে টেকা দিছো।
কথা বলা শেষ করে মইনুল সাহেব মোবাইলটা টেবিলে রেখে, আবার বাহিরে বের হলেন এবং পুর্বের স্থানে, পূর্বের মতই পত্রিকা পড়তে আরম্ভ করলেন। একটু সময় অবধিতে আবার রিং টোনের শব্দ। এবার তিনি ঘরে না গিয়ে অবিরাম পত্রিকা পড়তে থাকলেন। রিং টোন বেজে বেজে বন্ধ হল। এরপর আবার ২য় বার বাজতে আরম্ভ করল। তাতেও তিনি উঠলেন না। আবার সঙ্গে সঙ্গে ৩য় বার বাজতে আরম্ভ করল। এবার তিনি একটু বিরক্তি ভাব নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন এবং কলটি রিসিভ করে বললেনঃ
মঃ হ্যালো কে ?
তার ছেলে হিরন বললেনঃ
হিঃ আব্বা, আপনি কই ?
তিনি সেকথা ভাঙ্গা-ভাঙ্গা গলায় এবং কাঁদা-কাঁদা অবস্থায় বলছিলেন, সেটা ওনার বাবা বুঝতে পারলেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তরে বললেনঃ
মঃ ক্যান ? কি হইছে ?
হিরন সাহেব আবার কান্নার সুরে বললেনঃ
হিঃ আব্বা....
তৎক্ষনাৎ ওনার বাবা বললেনঃ
মঃ কি হইছে, ক।
হিঃ আব্বা, ঝিলিক টেম্পুতে যাওয়ার সময় এক্সিডেন্ট করেছে।
এ কথা শুনে তৎক্ষনাৎ মইনুল সাহেবের চোখ থেকে পানি ঝড়তে থাকল। এখন উনিও ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললেনঃ
মঃ তুই কি কছিস ?
হিঃ হয়। সত্যি। আপনি বের হন। আমি গাড়ী নিয়ে যাচ্ছি।
এই বলে লাইনটি কেটে দিলেন।

আর এদিকে মোকাররম আর তার ছোট ভাই কম্পিউটারে ইন্টারনেট চালাচ্ছিল। এমন সময় মোকাররমের মোবাইলটি বেজে উঠল। কলটি রিসিভ করে বললঃ
হ্যালো...
তার ফ্রেন্ড ফয়সাল ঝিলিকের বিষয়টি বলে দিল। মোকাররম শুনে বললঃ
মোঃ ফাজলামো করছিস ?
ফঃ ফাজলামো করব কেন ? সত্যি বলতেছি।
এ সময় মোকাররমের বুকটা যেন কষ্ট আর আর্তনাদে ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু তার পার্শ্বে তার ছোট ভাই থাকায় আর্তনাদের চিৎকার উচ্ছস্বরে প্রকাশ করল না। শুধু আস্তে করে বলে উঠলঃ
মোঃ ওহ, মাই গড !
এরপর বললঃ
মোঃ ও কোথায় আছে এখন ?
ফঃ বিরামপুর মেডিক্যালে।
এ কথা শুনে ফোন রেখে তার ছোট ভাইকে বললঃ
মোঃ রাজু, বাইকের চাবিটা দেতো।
রাজু বললঃ
রাঃ কই যাবি ?
মোঃ কই যাবো যাবো ; তারাতারি চাবিটা দে।
রাঃ আচ্ছা, ফেসবুকের আই.ডি. খোলাটা শেখা। তাহলেই দিচ্ছি।
মোঃ পরে শেখাব ; আগে চাবিটা দে, তারাতারি।
রাঃ আগে শেখা ; তাহলে দিচ্ছি।
একথা শুনে মোকাররম প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে গেল। মনে হচ্ছিল, সে যতটা কষ্ট অনুভব করছিল, তার সবটা যেন রাগে রূপান্তর হয়ে গেছে। তাই সে তখন আর কোন কথা না বলে, সরাসরি কম্পিউটারের বৈদ্যুতিক সংযোগটা বিচ্ছিন্ন করে, কম্পিউটারের মনিটর আর সি.পি.ইউ. দুটো মেঝেতে আছার দিয়ে ভেঙ্গে ফেলল। এ সময় তার মা পার্শ্বের ঘর থেকে এসে মটরসাইকেলের চাবিটা দিয়ে বললেনঃ
মো-মাঃ এই নে চাবি।

মোকাররম চাবি নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই মটরসাইকেল নিয়ে বিরামপুরের দিকে রওনা দিল। কিছুদুর যাবার পর তার মোবাইলটি বেজে উঠল। মোবাইলটি পকেট থেকে বের করে কানে ধরলে ফয়সাল বললঃ
ফঃ ঝিলিক ইজ ডায়েড।
একথা শুনে মোকাররমের চোখঁ মুখ বিবর্ণ্য ও বিষন্ন হয়ে উঠল। যেন বড় ধরনের এক কষ্টের পাথর তার বুকের মাঝখানে স্থাপিত হল। তার মনে হল, সে যেন পরীক্ষায় ফেল করেনি ; এক্সফেল করেছে। একদিকে তার ভালবাসাকে প্রত্যাখান, অপরদিকে ভালোবাসার মানুষটিকে চিরতরে হারানো। কতটায় কম হতে পারে সেই বেদনা ? যার মায়াবিনী চোখঁ, অনুপম হাসি, শুভ্র আর সুন্দর চেহারা, আর সে কখনই দেখতে পাবে না। তার মিষ্টি সুরের কথাগুলো আর কখনই শুনতে পাবে না। হাজারটা মেয়ের মাঝে খুজেঁ পাবে না আর ঝিলিককে। তাকে মৃত্যু থেকে ফিরানো যে আর সম্ভব নয়। এতে করে মোকাররমের অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা হয়তবা কাগজ কলমে কিংবা মুখে বলে বুঝাতে পারব না। কিন্তু মনে হয়, তখন তার শরীর থেকে একটি পার্টস্ নষ্ট হয়ে গেল। আর সেই পার্টসের নিষ্ক্রিয়তায় প্রভাবিত হতে থাকল তার সমস্ত শরীর।

মোকাররমের হৃদয় জুড়ে ঝিলিকের স্থান। তাকে নিয়েই তার স্বপ্ন, তাকে নিয়েই আশা। এমন স্বপ্ন ঝিলিকও দেখেছে কি না তা জানিনা তবে এখনও এমনটা প্রকাশ করেনি। আবার সরাসরি মোকাররমকে নাকচ করেও দেয়নি। তাই মোকাররমের মনে পড়ে গেল, ঝিলিকের সঙ্গে ইতিপূর্বে বলা সেই কথাগুলোঃ
ঝিঃ আমি তো চিরদিনের জন্য তোর না। অল্প কিছু সময়ের জন্য।
মোঃ না ; তুই চিরদিনের জন্যই আমার।
ঝিঃ আমার নাম ‘ঝিলিক’। আর ঝিলিক অর্থ ‘ক্ষণস্থায়ী আলোক’, যা অল্প সময়ের জন্য দেখা দিয়ে আবার হারিয়ে যায়। আমিও তোর কাছে অল্প সময়ের জন্য দেখা দিয়ে, হারিয়ে যাবো।
এ হারিয়ে যাওয়া বলতে ঝিলিক বুঝিয়েছিল, মোকাররমের কাছ থেকে দুরে যাবার কথা । কিন্তু সে যে শুধু মোকাররমের কাছ থেকে নয় ; আজ সকলের কাছ থেকে দুরে চলে গেল। তার নামের সাথে তার আত্মকাহিনীর এমনটা মিল হল কেন ? এই ভেবে প্রচন্ড ক্ষোভ হচ্ছিল মোকাররমের। ভাবল, “এই নামটি কে রেখেছিল ? কেন রাখা হল এই নামটি” ?

আর এদিকে ঢাকায় ঝিলিকের নানী ওনার মেয়েকে জরিয়ে ধরে কান্নার সুরে বলছিলেন,
ঝি-নাঃ তুই মোক ক্যান ঢাকায় নিয়ে আলু ? মুই বাড়ীতে থাকলে অক কখনই টেম্পুতে উঠে তে দিনুনা হয়।


আবার এদিকে দিনাজপুর থেকে ঝিলিকের মা ও বাবা বাসে করে আসতেছিলেন। এ সময় ঝিলিকের মা ঝিলিকের বাবাকে কাঁদা-কাঁদা অবস্থায় বলছিলেনঃ
ঝি-মাঃ তুমি ক্যান ঝিলিককে ওর নানীর বাসায় রাখতে বলছিলে ? আমি তো আমার কাছেই ওকে রাখতে চাইছিলাম।

আর হাসপাতালের বাহিরে তখন মইনুল সাহেব কাদঁতেছিলেন আর হিরন তার স্ত্রীকে মোবাইলে বলছিলেনঃ
হিঃ তোমাকে আর বড়ীতে আসার দরকার নাই।
হি-স্ত্রীঃ কেন কি হয়েছে ?
হিঃ কি হয়েছে মানে ? এত মানুষ জানে, তুমি জাননা ? কেউ তোমাকে ফোন করেনি ?
হি-স্ত্রীঃ কি হয়েছে সেটা তো বলবে।
হিঃ ঝিলিক-ঝিলিক...
হি-স্ত্রীঃ ঝিলিকের কি ?
অত্যন্ত করুন সুরে বললঃ
হিঃ ঝিলিক, ঝিলিক, সকলকে ছেড়ে চলে গেছে চিরদিনের জন্য।
একথা শুনে তার স্ত্রীর হাত থেকে মোবাইলটা মাটিতে পড়ে গেল।

আর এদিকে কল কেটে দিতেই, হিরনের ফোনে একটি এস.এম.এস. আসল যেটা মোকাররম পাঠিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, “ওর নাম কেন ঝিলিক রাখা হয়েছিল ? ঝিলিক মানে কি জানেন ? যা অল্প সময়ের জন্য দেখা দিয়ে আবার হারিয়ে যায়। ঝিলিক ও ঠিক সেরকম অল্প সময়ের জন্য আমাদের মাঝে এসে আবার হারিয়ে গেল।” এই এস.এম.এস. টা দেখে হিরন সাহেব সঙ্গে সঙ্গে ঝিলিকের বাবার কাছে কল করলেন। তখনও ঝিলিকের বাবা-মা গাড়ীতে। ঝিলিকের বাবা কলটি রিসিভ করলে হিরন একটু রাগ ও বিচলীত হয়ে বললেনঃ
হিঃ দুলাভাই, ঝিলিক মানে কি জানেন ? ক্ষনিকের আলোক, যা অল্প সময়ের জন্য দেখা দিয়ে আবার হারিয়ে যায়। আপনার মেয়ের নাম কেন ঝিলিক রেখেছিলেন?
ঝিলিকের বাবা সেসব কথা চুপ করে শুনতেছিলেন। আর হিরন সাহেব ওনার কথা বলার আওয়াজ আস্তে আস্তে জোড়ালো করছিলেন এবং বললেনঃ
হিঃ আর কোন নাম ছিলনা ? পৃথিবীতে আর কোন নাম ছিলনা ? ছিলনা আর কোন নাম ?
এই বলে লাইনটি কেটে দিল।

তবে যাই হোক, সকলেই জানেন, ঝিলিকের নাম, তাকে বিরামপুরে ভর্তি করানো, তার নানীকে ঢাকায় পাঠানো, এসবের কোনটায় ঝিলিকে মৃর্ত্যুর জন্য দায়ী নয়। মৃর্ত্যুর সময় আলিঙ্গন করলে, অনুপম এই বসুন্ধরাকে ছেড়ে যেতে হবে সকলকেই। এটাই চিরসত্য। আর এই সময় কখন কার জীবনে আলিঙ্গন করবে, সেটা আমি, আপনি, আমরা কেউই জানিনা। এমনকি নিজেরটা নিজেও নয়। হয়তবা খবরটা শুধু সৃষ্টিকর্তার হাতেই রয়। এসব কিছু জেনেও কেউ যখন আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যায়, তখন মনে হয়, কি কি করলে আর কি কি না করলে, সেই মানুষটি আমাদের কাছেই রয়ে যেত। আর ঝিলিকের আপনজনদেরও ঠিক এমনটায় মনে হয়েছিল।

এখন সেই মোকাররমের কথা বলি যে ঝিলিককে তার জীবনের সবচেয়ে বেশী আপন বলে মনে করেছিল। যে ঝিলিকের কাছ থেকে দুরে থাকালে বিষণ্ণতার প্রহর কাটাত, সেই ঝিলিক আজ হারিয়ে গেল চিরতরে। তাই ওকে নিয়ে তার ভাবনার রেশটা, মটরসাইকেল চালনার মাঝেও কমাতে পারছিল না বরং ক্রমান্বয়ে বাড়তেছিল। এই গভীর চিন্তামগ্নতার জন্য মটরসাইকেল নিয়ন্ত্রনে ব্যাঘাত ঘটল। হঠাৎ করেই ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে গেল তার গাড়ীটি। আর সেও হয়ে গেল গাড়ীটির মতই। চিরদিনের জন্য সেও হারিয়ে গেল সুন্দর এই পৃথিবী থেকে। যাকে খুজঁলেও আর পাবেনা তুমি, আমি কিংবা অন্যকেউ। হয়তবা টাকা হলে নর-নারীও কেউ কিনে নিতে পারে কিন্তু ঝিলিক আর মোকাররমকে আর কেনা যাবেনা। পাওয়াও যাবেনা কোন কিছুর বিনীময়ে। পাবার যে কোন উপায় নেই। সৃষ্টিকর্তা যে তাদের কপি/নকল বের করেনি। আমার যদি ছোট্ট একটি জিনীষ হারিয়ে যায় কোন কপি নেই, তাহলে অনেক দুঃখ হয়। তাহলে যাদের সন্তান, যাদের আত্মীয়, যাদের বন্ধু, যাদের প্রতিবেশী, তাদের মোকাররম আর ঝিলিক হারানোর দুঃখটা কি কম হবে ! মোটেও নয়।

তবে যাই হোক, মোকাররম ও ঝিলিকের আর কিছু কথা বলেই গল্পটা শেষ করি।
মোকাররম ঝিলিককে বলেছিল “আমার মনে হয়, তুই চিরদিন আমার পাশেই থাকবি” কিন্তু এ ব্যাপারে ঝিলিক মোকাররমের কাছে কোন আগ্রহ দেখায় নি। কিছু ফুল যেমন প্রস্ফুটিত হয় না, কিছু পাখি যেমন কখনই গান গায় না, হয়ত তার চাওয়াটাও পূর্ণ হবেনা, এমনটায় মেনে নিয়েছিল ঝিলিক। হয়ত তার নানা মইনুল সাহেবের জন্যই মোকাররমের কাছে তার ভালবাসাকে মনের মধ্যেই চেপে ধরে রাখতে হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের এ কি পরিহাস ! মইনুল সাহেব বাস্তবে ঝিলিককে মোকাররমের পাশাপাশি না রাখতে চাইলেও, নিজ হাতেই ওদের দুজনকে পাশাপাশি সামাধি করে গেলেন। এখন মইনুল সাহেব কেন ? পৃথিবীর আর কেউ‘ই তাদের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি করতে পারবে না। ওরা পাশাপাশিই রয়ে যাবে, অফুরন্ত সময়ের জন্য।

***...***সমাপ্ত***...***

প্রধান থিমঃ  30/01/2013
সর্বশেষ সংশোধনঃ  24/05/2013
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮০৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২০/০৯/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

 
Quantcast