www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আলো ছায়ার আধারে

একটি বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে বিকেলের পর পুরান ঢাকায় নিজ এলাকায় ঘন্টা খানেক সময় দিতে হয় তখন মাঝে মধ্যে মহল্লার একটি নির্দিষ্ট স্থানে ক্লাবে আড্ডা দিতে যাই, উদ্দেশ্য ছেলেবেলার এলাকায় পুরোনো বন্ধুদের সাথে কিছু সময় কাটানো । আর মজার মজার খাবারের আতিথ্য। তাছাড়া ক্লাবটি প্রতিষ্ঠায় আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থাকায়, আমি সেটার আজীবন সদস্য, নিজ এলাকায় বসবাস না করার কারনে আমি এক রকম অনিয়মিতই ক্লাবে।
সেখানে আমার একজন পরিচিত বড়ভাইসম বন্ধুজন ছিলেন, আসাদ ভাই, পেশায় বেকার,একসময় সরকারি গ্রন্থাগারিক ছিলেন,পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া একটি দোতালা বাড়ীর মালিক,ধনী না হলেও অসচ্ছল নন,বাড়ী ভাড়াতেই সংসার চালান, স্ত্রী সহ স্কুল পড়ুয়া দুই পুত্রের জনক। তিনি আমার থেকে বয়সে বেশ বড়ই হবেন, এলাকার লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন কিন্তু ঘনিষ্ঠতা বা সখ্যতা ছিলোনা,ভয়াবহ রকম হাসিখুশি, আমাকে বিনা কারনেই তার খুব পছন্দ এবং আমি ভয়াবহ ভাবে তার খাতিরের শিকার ছিলাম। আমার কাচা পাকা চুল ছিলো তার আক্রমনের আর তামাশার বিষয়, তিনি নিজেকে একজন হিউম্যান এন্সাইক্লোপেডিয়া মনে করতেন , না জানলেও সব আড্ডার বিষয়ে একটা মতামত দিতেন , প্রতিটি আর্গুমেন্টে চোখ ও চশমা কপালে তুলে একটা বিশাল হাইপোথিসিস ত্যাগ করতেন । আমিও যুক্তি কৌশলে তাকে সামলাতাম, বুঝতাম উনি উপোভোগ করতেন। তার পছন্দের কারনে মাঝে মাঝে ভালোই যন্ত্রনা পোহাতে হোতো আমাকে।
আমি বাসায় রাতে একটু আর্লি ঘুমাইতে চাই , উনি আমাকে ফোন দিয়া দেশের কি হবে, স্টক মার্কেটের কি অবস্থা, টক শোতে কে কি বল্লো আলাপে ঘুমের দফা রফা করতেন। আমি আড্ডায় ক্লান্ত হয়ে একটু নিরিবিলি স্পেস চাই , উনি আমাকে গ্রুপ ডিসকাশনে নিয়া ফেলতেন , আমি ক্লাবে টিভিতে খবর দেখতে চাই , উনি চোখ বড় বড় করে বলতেন কি খবর শুনবেন খবরে আজকাল সত্য বলে কিছু আছে নাকি " বলেই রিমোটটি দখলে নিতেন এবং বোধকরি নিজের অজান্তেই রিমোট চাপতে চাপতে ঝলমলে কোনো ভারতীয় চ্যানেলে গিয়ে আটকে যেতেন " , এমনকি আমি ক্লাবে আমার প্রিয় খিড়ী কাবাব খেতে বসলে উনি উড়ে এসে হা-হা করতে করতে মাথা ঝাকিয়ে বলতেন,"টেক ভেজিটেবলস,ম্যান ; ইটস্ কোলেস্টোরল "বলেই দু তিন পিস নিজের মুখে লোপাট করে দিতেন। আর আমার ধুম্রশলাকার স্টক তো ওনার নিজস্ব সম্পত্তি ছিল । ক্লাবে তার তৎপরতা মোটামুটি ফানি ভিডিও ক্লিপ হিসেবে বাজারে ছাড়ার যোগ্যতা রাখতো । ভদ্রলোকের চেহারাটা দেখতে কফিনের মত , চারকোনা । ক্লাবের সবাই তার কর্মকাণ্ডে মজা পাওয়ার সাথে সাথে বিরক্তও হোতো আমি মেজাজ খারাপ করে একদিন বলেই ফেললাম ,"লুক ইফ ইউ হ্যাভ এনিথিং রেলেভেন্ট টু টক এ্যাবাউট, দেন টক ; আদারওয়াইজ , প্লিজ ডোন্ট "
সে সম্ভবত আমার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিলো। কদিন ধরে চুপচাপ মন খারাপ করে একজায়গায় বসে থাকতেন, তার নিয়মিত চাঞ্চল্য বিদায় নিয়েছিলো, সেই জন্য বন্ধুসহ অন্যরা আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলো, কড়া ভাষায় তাকে শুধরাতে বলার জন্য । কিন্তু আমার নিজেরো একটু খারাপ লাগতো ওনার নিরবতায়, অতটা রুক্ষ না হলেও পারতাম । তারপরও একটু ভাব নিয়ে থাকতাম যেনো আবার পেয়ে না বসে, একদিন আর ভালো লাগছিলো না, নিজেই সেধে তার কাছে গেলাম, হেসে জিজ্ঞেস করলাম, কেমোন আছেন,বিব্রত হাসিতে উত্তর দিলেন জি ভালো,আপ্নি ভালোতো ?
সেদিন তার মন ভালো করার জন্য তার একটা ছবি তুলে দিলাম। সে অনেকক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাত আমার ফোনটা হাত থেকে নিতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় ফেলেই দিলো আমি চরম বিরক্ত ও হতাশ হয়ে তাকাতেই ,তিনি নির্বিকার ভাবে বললেন,"গুডশট,হাসান ভাই;আই লুক লাইক আ পলিটিশিয়ান দাড়ান সবাইকে একটু দ্যাখাইয়া আনি। বলেই ছুট, আমার সাথের বন্ধুরা বল্লো দেখলি চুপচাপ ছিলো ভালো ছিলো ক্যান গেলি খাতির দেখাইতে?

মুহূর্তে সামলে ওঠা, আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা , কেনো যানি মনে হোলো ভদ্রলোক প্রচণ্ড দুঃখী একজন মানুষ । এই হই চই হাসি ঠাট্টা তামাশা সবই কোনো কিছুকে আড়াল করার জন্য, ক্লাবে এসে হইহুল্লোর করে নিজেকে ভুলিয়ে রাখেন। একদিন বসবো ওনার সাথে, কে যানে কোনো লেখার প্লট পেয়ে যেতে পারি হয়তো। পরবর্তীতে নানান কাজ, আর বিদেশ সফরের কারনে অনেক দিন ক্লাবে যাওয়া হয়নি, আর বসা হয়নি, তবে আমার সেই ধারনা সত্যি হয়েছিলো। একদিন পত্রিকার পাতায় ভদ্রলোকের ছোট্ট ছবি দেখে নীচে ক্যাপশনটা পড়েই এক বন্ধুকে ফোন দিলাম, তার কাছে শুনলাম,ভদ্রলোকের করুন পরিনতি, স্ত্রী চরম বদমেজাজী মহিলা, কিছু করতেন না বলে সবসময় স্বামীকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সাথে অপমান করতেন, সন্তান গুলোও মায়ের মত বাবাকে সন্মান করতোনা। আরো কিছু না জানা কষ্ট ছিলো বোধহয়,
পারিবারিক অশান্তিতে ভদ্রলোক চলন্ত ট্রেনের নীচে নিজ শরীর পেতে দিয়েছিলেন।

এক বন্ধুর কাছে পরে শুনেছিলাম আত্মহত্যা করার কিছুদিন আগে থেকেই নাকি উনি আমাকে খুজছিলেন আমার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন, ওই সময় আমি দেশের বাইরে, কেনো খুজেছিলেন আমাকে? কিছু কি বলতে চেয়েছিলেন, নিয়তিই বোধহয় দেখা হতে দিলো না । ঘটনার কিছুদিন পর আমি আবার একদিন ক্লাবে গেলাম,আমাদের ফুটফরমায়েশ খাটা ছেলেটা এসে সালাম দিয়ে নিচু স্বরে বল্লো স্যার আসাদ সাহেব একটা চিঠি দিয়ে গেছেন শুধু আপনার হাতে দেয়ার জন্য আর বলেছেন এটার কথা আর কেউ যেনো না জানে । অনেকটা কাপা হাতেই চিঠিটা খুললাম, মোটামূটি দীর্ঘ চিঠি, বাসায় গিয়ে পড়বো বলে ভাজ করে পকেটে ঢুকালাম। প্রিয় পাঠক প্রয়াত আসাদ ভাই চিঠিতে লেখা বিষয় বস্তু কাউকে জানাতে সবিনয়ে নিষেধ করেছেন,তাই তা বিস্তারিত প্রকাশ করলাম না, তবে চিঠিটা পড়ার সময় আমার চোখ পানিতে ভরে গিয়েছিলো, পৃথিবীতে সবচেয়ে কাছের আপন মানুষগুলো তার সাথে দিনের পর দিন বছরের পর বছর যে অন্যায় আচরন, মানসিক অত্যাচার, করে যাচ্ছিলো,শুধু ধৈর্যশীল সরল ও পরিবার প্রীতির কারনে তিনি তা সহ্য করে গেছেন। খানিকটা ভিতুও হয়তো ছিলেন, যার কারনে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন নি । কোনো এক অদ্ভুত কারনে আমাদের সমাজ স্ত্রী-সন্তানদের হাতে স্বামীদের নিগ্রহের চিত্রটি লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে, অনেকসময় যার পরিনতি হয় এরকম।
সত্যি হাসি খুশি চেহারার পিছনে মানুষের কত কান্নাই না লুকিয়ে থাকে...।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৬৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩০/১১/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • তালি হবে!!!
  • Saurav Goswami ০৩/১২/২০১৫
    সুন্দ্ র ।
  • দেবাশীষ দিপন ০৩/১২/২০১৫
    অনেক সুন্দর উপস্থাপনা।ভাল লাগলো পড়ে।
  • ধন্যবাদ আপনাকে।
  • কিশোর কারুণিক ০১/১২/২০১৫
    দারুণ
  • অভিষেক মিত্র ০১/১২/২০১৫
    দারুণ লাগল দাদা।
  • গল্প পড়ে অনেক ভালো লাগলো
  • অনেক সুনদর হয়েছে।আমি গল্পের ফর্মেটা এখনো না ঠিক মত বুঝি না। গল্প লিখতে গেলে কিছুটা নাটক বা কথোপকথন আকারে এসে যায়।কি করি বলুন তো?
    • হাসান কাবীর ০১/১২/২০১৫
      আসলে আমরা যারা লিখতে পছন্দ করি, খুব প্রস্তুতি নিয়ে তারপর শুরু করি, তা কিন্তু নয়, আপনার কল্পনার সাথে আবেগটা মিশিয়ে দিন, মিশ্রন ভালো হলে, একটা সুন্দর উপস্থাপনা এমনিতেই এসে যাবে, আপনি পারবেন।
  • অনেক সুন্দার হয়েছে।
 
Quantcast