www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বেদেদের বিচিত্র জীবনধারা

"খা খা বক্ষিলারে কাঁচা ধইরা খা-
খেলা দেইখ্যা যে পয়সা না দেয়,
তারে ধইরা খা!”
সাপের ঝাঁপি মাথায় নিয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়ানো বেদে নারীদের এমন সুরেলা কণ্ঠ আগের দিনে শোনেনি, এমন মানুষ পাওয়া ছিল ভার। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের লোকায়ত সংস্কৃতির অনেকটা জুড়ে আছে এই বেদে সমাজ। গল্প, কবিতা, উপন্যাস থেকে শুরু করে সেলুলয়েডের পর্দায় কত রূপে বেদে-বেদেনী উপস্থিত হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বেদের মেয়ের আগে এবং পরে অসংখ্য কবি সাহিত্যিকের কলমে নানা আখ্যান উঠে এসেছে বেদেদের ঘিরে। আজ এ ঘাটে, কাল অন্য ঘাটে। আজ এখানে, কাল ওখানে। যাযাবরদের মতো জীবনধারার বেদেদের রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ ও সংস্কৃতি। রয়েছে নিজস্ব জীবনবোধ ও স্বকীয়তা। এখন আর আগের মতো বহর নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বেদে নারী-পুরুষদের তেমন একটা দেখা যায় না। সাপ নিয়ে খেলা দেখানো সাপুড়েদের সংখ্যা কমে গেছে। জীবনযাপনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যাযাবর জীবন ছেড়ে অনেকেই স্থায়ী বসত গেড়েছে। জীবিকায় লেগেছে টানাপোড়েন। আমাদের লোকজ সংস্কৃতির ধারা থেকে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধ এ ধারাটি। কিন্তু তাই বলে বেদেদের নিয়ে কমেনি কৌতূহল।

বেদেদের আগমনঃ
বাংলাদেশে বেদেদের আগমন ও বিস্তার নিয়ে রয়েছে নানা মত। বেদেরা নিজেরাও বিষয়টি সম্পর্কে নানা মত দিয়েছে। কারও কারও মতে-বাংলাদেশে বেদেদের আগমন আরাকান অর্থাৎ আজকের মিয়ানমার থেকে। ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন আরাকানরাজ বল্লাল রাজার সঙ্গে শরণার্থী হিসেবে তারা এদেশে এসেছিল। পরবর্তীকালে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আবার কারও কারও মতে প্রাচীনকালে তারা সুদূর মিসর থেকে এসেছিল। তারা বেদুইন জনগোষ্ঠীর। বেদুইন থেকে বেদে শব্দের উৎপত্তি। বেদে সমাজে জনশ্রুতি রয়েছে, ভারতে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার পান্ডুয়াতে বেদেরা এক সময়ে রাজত্ব গড়ে তুলেছিল। আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে, বেদেরা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুরা জেলার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের উত্তরসূরি। বেদেদের আগমন ও ছড়িয়ে পড়া সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের এসব মতামত ও জনশ্রুতির কোনটা সঠিক, তা নিরূপণ করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য এবং বিতর্কের বিষয়। তবে এটি প্রায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন যে, বেদে সম্প্রদায় বাংলাদেশে কয়েক শ’ বছর ধরে আছে এবং এদেশের সমাজ-সংস্কৃতিতে মিশে গেছে।

নানা নাম ও গোত্রঃ বাংলাদেশে বেদেরা বেদে, বেদিয়া, বাইদ্যা, সাপুড়ে,মিশ্চিয়ারিসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত। ভারতের পশ্চিম বাংলাতেও বেদেরা এসব নামে পরিচিত। তবে ভারতের উড়িষ্যায় ‘খের’, উত্তর ভারতে ‘সপেরা’, অসমে ‘অঘোরিমান’, বোরো অঞ্চলে ‘হুগড়া’, মহারাষ্ট্রে ‘মাহব’ এবং ইংরেজীতে ‘বেদিয়া’ নামে ডাকা হয়। ভারত এবং বাংলাদেশ মিলে বেদেদের জনসংখ্যা ২০ লাখের মতো। বেদে সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক গোত্র বা গোষ্ঠী রয়েছে। যারা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। বেদেরা ‘গোত্রকে’ বলে ‘জাত’। মূলত পেশার ওপর ভিত্তি করেই এসব গোত্র বা গোষ্ঠীর নামকরণ হয়েছে। যেমন-যারা সাপ খেলা দেখায় এবং সাপ কেনাবেচা করে তারা সাপুড়িয়া। যারা ঝাড়ফুঁক করে তারা মিশ্চিয়ারি। যারা জাদু দেখায় তারা বাজিগর বা মাদারি নামে পরিচিত। শারীরিক কসরত দেখিয়ে জীবিকা অর্জনকারীরা চামরিয়া নামে পরিচিত। কাঁচের চুড়ি ও মালা যারা বিক্রি করে তারা সান্দার এবং যারা হাঁড়িপাতিলসহ সাংসারিক জিনিসপত্র বিক্রি করে তারা সওদাগর নামের গোত্রভুক্ত। তাবিজ কবজ বিক্রি করে ধবাইলা গোত্রের বেদেরা। যারা মাছ ধরে তারা মানতা। এ ধরনের আরও কয়েকটি গোত্র রয়েছে, যা ইরানিয়া, লারপুরিয়া, ব্যাবাইজ্জা, লাউয়া, ললুয়া, মালি, আমান, পাঁচ ভাইয়া, ষোলো গ্রাম, একুশ গ্রাম, কাগমারা, বহুরূপী, কালান্দর, নরসিংহা, বেচ, বাজানিয়া ভাতু, যোগি, ছাতা, কঙ্গর, মালবেদে, বড়িওলাসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত।

বেদেদের ঠিকানাঃ একটা সময়ে বেদেরা জীবনযাত্রায় ছিল পুরো যাযাবর। কোথাও তাদের স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। নৌকায় ছিল ঘরবসতি। সময়ের প্রভাবে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে বাস করছে। বিশেষত ঢাকার সাভার, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই, তিনটুরী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, এনায়েতগঞ্জ, ফেনীর সোনাগাজী এবং উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর ও নাটোরসহ বিভিন্ন জায়গায় এসব বেদের বাস। তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ এখনও টিকে আছে। সুনামগঞ্জের সোনাপুরে বাস করে বেদে সমাজের বৃহত্তর অংশ। আবদুল্লাহপুর, মীরকাদিম, চিতলী, মাকহাটি এলাকায় বেদেদের আদি বাস ছিল। এসব এলাকা থেকেই সম্ভবত তারা ভাটপাড়া, বক্তারপুর, আমিনবাজার প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বছরে অন্তত তিন-চার মাস তারা স্থায়ী ঠিকানায় বাস করে। পেশার টানে বছরের অন্যান্য সময়টা তারা সারাদেশ ঘুরে কাটিয়ে দেয়। তারা বহর বেঁধে চলাফেরা করে। একেকটি বহরে দশ-বিশটা থেকে ৫০/৬০টিরও বেশি নৌকা থাকে।

বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনধারাঃ বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন কৌমসমাজের রীতিনীতি মেনে চলে এবং দলবদ্ধ হয়ে বাস করে। তাদের গোত্রপ্রীতি প্রবল। তাই একে অপরকে নানাভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করে। পিতৃপ্রধান সমাজ হলেও মেয়েরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেদে ছেলেরা অলস প্রকৃতির। জীবিকার্জনসহ সব রকমের কঠোর পরিশ্রম করে নারীরা। নারীরা যখন দল বেঁধে গাঁও-গ্রামে সাপের খেলা বা তাবিজ কবজ বিক্রি করতে যায়, তখন এটিকে তারা ‘গাওয়াল’ বলে। বেদেদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। যা ‘ঠার’ হিসেবে পরিচিত। অন্যদের কাছ থেকে নিজেদের গোপন কথা লুকাতে ঠার ভাষা ব্যবহার করে। বেদে সমাজে বহুবিয়ে, বাল্যবিয়ে ও যৌথ পরিবার প্রথা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার প্রধানের মতে ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়। বেদে সম্প্রদায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে- সরদার। যার নির্দেশ পুরো সমাজে প্রাধান্য পায়। সরদারের নির্দেশে বহর কোথায় নোঙর করবে, তা যেমন নির্ধারণ হয়, তেমনি ছেলেমেয়েদের বিয়ে থেকে শুরু করে বিচার-সালিশ সবকিছুতেই সরদারের আদেশ অপরিহার্য। বেদেদের প্রতিটি পরিবারে নিজস্ব নৌকা থাকে। কয়েকটি পরিবার বা নৌকা নিয়ে বহর হয়। সরদার প্রতিটি বহর বা দলের বাণিজ্যপথ ও এলাকা নির্ধারণ করে, যাতে দলের অন্যান্যরা প্রয়োজনের সময়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। বহরের প্রশাসনিক ও নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার সকল দায়িত্ব সরদারের।

অন্য অনেক আদিবাসীর মতো বেদেরাও এই জললগ্ন ভূমিরই সন্তান। বেদে সম্প্রদায় কোন আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালন করে না। তবে তারা যেমন নিজেদেরকে ধর্মে মুসলমান হিসেবে দাবি করে, তেমনি লোকজ অনেক দেব-দেবী, বিশেষত মনসা বা বিষহরির পূজা করে। অনেকে জলের দেবতা গঙ্গার পূজা করে। তবে সে পূজা পদ্ধতির সঙ্গে যতটা না ভক্তি-অর্চনার সাদৃশ্য, তার চেয়ে বেশি সাদৃশ্য লোকজ ব্রত-পার্বণের সঙ্গে। বেদে সম্প্রদায়ের বিয়ের রীতি মুসলিম ধর্মীয় মতে হলেও তাদের রীতিনীতিতে বিচিত্র কিছু প্রথা রয়েছে। যেমন উপার্জনের মৌসুম শেষ হলেই কেবল বেদে পরিবারে বিয়ের আয়োজন হয়। বিয়েতে তারা সবচেয়ে বেশি আনন্দ করে। বেদেদের বিয়েতে আপ্যায়ন কিংবা উপহার দেয়ার নিয়ম নেই। সাধারণত বর-কনে একে অপরকে পছন্দের ব্যাপারটা বিয়ের অনুষ্ঠানে সেরে নেয়। বিয়েতে বর-কনেসহ উপস্থিত সবাইকে নাচগান করতে হয়। বাইরের কেউ এলে তাকেও নাচতে হয়। এসব নাচ-গান একান্তই বেদে সম্প্রদায়ের। এ সময় অবিবাহিত মেয়েরা খুব আকর্ষণীয় সাজগোজ করে অন্য যুবকের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টায়। কয়েকটি গোত্রের মধ্যে ভিন্ন প্রথার প্রচলন রয়েছে- বিয়ের আগে হবু বরকে উঁচু গাছের মগডালে উঠে বসতে হয়। কনে নিচে দাঁড়িয়ে বরকে নেমে আসার জন্য অনুরোধ করে। এক পর্যায়ে কনে বরকে নানা প্রলোভন দেখাতে শুরু করে। কনে অঙ্গীকার করে ‘আমি তোমার সংসারের কাজ করব। শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করব। ছেলেমেয়েদের লালন পালন করব।’ এরপরেও বর নির্বিকার ডালে বসে থাকে। কনে এবার বলে-‘আমি তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করব না। তুমি যা বলবে তাই শুনব।’ এরপরও বর বসে থাকে। শেষে যখন কনে বলে-‘তোমাকে আমার ভরণ-পোষণ করতে হবে না, বরং আমিই তোমাকে সারাজীবন রোজগার করে খাওয়াব।’ তখন বর নেমে আসে। এরপর তাদের বিয়ে হয়।

আবার কয়েকটি গোত্রের মধ্যে বিয়ে করতে হলে কনেকে অর্থ দিতে হয়। যার যেমন সামর্থ্য। এ অর্থ বেদেনীর কাছে গচ্ছিত থাকে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন কারণে ছাড়াছাড়ি হলে সম্পত্তি, ছেলে-মেয়েও ভাগাভাগি হয়। সরদার বিচার করে যা রায় দেয়, উভয়পক্ষকে তা মেনে নিতে হয়। বিয়ের রাতে স্বামীকে সন্তান পালনের জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হয়। যতদিন স্ত্রী উপার্জনের জন্য বাইরে থাকে, ততদিন স্বামীকে সন্তান প্রতিপালন করতে হয়। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর ঘরে যায়। স্ত্রীর ঘরই স্বামীর ঘর। বেদে নারীরা স্বামীদের আঁচলে বেঁধে রাখতে তুলনাহীন। পুরুষ বশে রাখতে তারা নানা কৌশল অবলম্বন করে। কোন পুরুষের পক্ষে বেদে নারীর এ কৌশল উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। অন্য গোত্রের কেউ বেদে নারীর মায়ার জালে পড়লে তাকেও গোত্রের হয়ে থেকে যেতে হয়। তাছাড়া, পুরুষকে ধরে রাখার জন্য তারা তন্ত্রমন্ত্র, তাবিজ-কবজ করে। পুরুষ বেদে নারীর কাছে দেবতার মতো। সব ঝামেলা থেকে তারা স্বামীকে আগলে রাখে। নতুন নৌকা তৈরি শেষেও তারা উৎসব করে।

বেদে সম্প্রদায়ের নারীদের মমত্ববোধ, পরিশ্রম, প্রেম-ভালবাসা আমাদের লোককাহিনীকে জুগিয়েছে বাড়তি খোরাক। প্রাগৈতিহাসিক কাল ধরে মানুষের চিত্তাকর্ষণ করার লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন চটুল গান রচনা করেছে। এটা করতে বেদে নারীদের শরীরী ভাষাও প্রকাশ হয়েছে। যা সহজেই অন্যকে প্রলুব্ধ করে। গানের ভাষায় উঠে এসেছে তাদের নিত্যকার জীবনে ব্যবহার্য জিনিসের নাম, সাপের নাম, বিভিন্ন উপাসক দেব-দেবীর নাম, বিপরীত লিঙ্গস্তবক, প্রেম, বিরহ, বৈরাগ্য, আধ্যাতিকতা প্রভৃতি। কিন্তু আজকাল বিনোদনের নতুন নতুন ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে। তাই আগের মতো মানুষ সাপ খেলা দেখে এখন আর আনন্দ পায় না। তাছাড়া বেদেদের ওষুধে এখন বিশ্বাস নেই। বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় আগের মতো সাপও পাওয়া যায় না। তাই বেদেদের ঐতিহ্যগত পেশায় ধস নেমেছে। এতদিনকার সংস্কার-বিশ্বাসে আঘাত এসেছে। অভাবের কারণে সংসারে ভাঙন লেগেছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেদে নারীরা। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে তারা হারিয়ে যাচ্ছে অজানা অন্ধকারে। কালের আবর্তে আজ বেদে সম্প্রদায়ের চিরাচরিত জীবন-প্রণালী ধ্বংসের মুখে। বর্তমানে বেদেদের একটি বড় অংশ ঠিকানাবিহীন ও অনিশ্চিত জীবনযাপন করছে। জীবিকার সন্ধানে তারা খুঁজে নিচ্ছে নানান পথ।

লেখকঃ ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৯২৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২০/০৪/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast