www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শিক্ষা শিক্ষক ও একজন ওয়াহাব বিএসসি স্যার

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড এবং শিক্ষাব্যবস্থাই হচ্ছে মানুষ গড়ার সর্বোত্তম কারখানা। আর জাতি ও দেশ গড়ার একমাত্র হাতিয়ার। শিক্ষার এই অপরিসীম গুরুত্বের ক্ষেত্রে চীন দেশীয় একটা প্রবাদ বাক্যের স্মরণ করা যেতে পারে- ‘‘তুমি যদি এক বছরের পরিকল্পনা নিয়ে থাক।তাহলে শস্য দানা বপন কর। তুমি যদি দশ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে থাক। তাহলে বৃক্ষরোপণ কর এবং তুমি যদি এক হাজার বছরের পরিকল্পনা নিয়ে থাক। তাহলে মানুষ তৈরির ব্যবস্থা কর। এই যে, হাজার বছরের পরিকল্পনা নেয়া তথা মানুষ তৈরির ব্যবস্থা করাই হল শিক্ষা । শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়া হয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সকল দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা হয়। শিক্ষা হল সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। বাংলা শিক্ষা শব্দটি এসেছে ‍'শাস' ধাতু থেকে। যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। অন্যদিকে শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ এডুকেশন এসেছে ল্যাটিন শব্দ এডুকেয়ার বাএডুকাতুম থেকে। যার অর্থ বের করে আনা অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা। সক্রেটিসের ভাষায় “শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।” এরিস্টটল বলেন “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা”। জন মিল্টনের ভাষায় – শিক্ষা হল দেহ, মন ও আত্মার সুষম বিকাশ সাধন করা।” ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “শিক্ষা হল তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।”
২.
শিক্ষক ও শিক্ষণ শব্দ দু’টির সাথে আমাদের সম্যক পরিচিত হওয়া দরকার। শিক্ষক ( শিক্খক্ )শব্দটির বুৎপত্তি হলো- ( √শিক্ষ্ + ণিচ্ + অক )। এ ছাড়া শব্দটির বহুল প্রচলিত সমার্থক শব্দগুচ্ছ হলো – শিক্ষাদাতা, অধ্যাপক, উপদেষ্টা, গুরু, মাস্টার, ওস্তাদ, শাসনকর্তা । বর্তমানে শাসনকর্তা শব্দটি কালের বিবর্তনে সুশীল সমাজে হারিয়ে যেতে বসেছে। শব্দটির স্ত্রীবাচক শব্দ ও আছে। যথা: শিক্ষিকা, শিক্ষয়িতা,শিক্ষয়িত্রী। বর্তমানে লিঙ্গভেদ না মেনে সমাজে শিক্ষক শব্দটিই শ্রুতিমধুর হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। শিক্ষণ, শিখন কার্যক্রমের সঙ্গে যে পেশা জড়িত, সেটাকেই আমরা শিক্ষকতা বলি। শিক্ষণ : (√শিক্ষ্ + অন)। সমঅর্থ হলো- শিক্ষা গ্রহণ, অধ্যয়ণ,শিক্ষাদান, অধ্যাপনা, তালিম, হাতে কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা, শিক্ষক-শিক্ষণ ইত্যাদি। শিক্ষকতার সাথে শিক্ষণ শব্দটি নিবিড়ভাবে জড়িত। অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের ফলে আচরণের যে কাঙ্খিত স্থায়ী পরিবর্তন হয়, তা-ই শিক্ষন।
একজন শিক্ষক একটি সমাজ ও একটি জাতিকে বদলে দিতে পারেন। সমৃদ্ধ করতে পারেন মানুষের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যকে। শিক্ষক ছাড়া একটি সভ্য সমাজ কখনই কল্পনা করা যায় না, যাবেও না। শিক্ষকের সার্থকতা শুধু শিক্ষা দান করায় নয়, ছাত্রকে তা অর্জনে সক্ষম করায়। শিক্ষক ছাত্রের জ্ঞান পিপাসাকে আরো জ্বলন্ত করে দিবেন তৎসঙ্গে তার বুদ্ধিবৃত্তিকে আরো ক্ষুরধার করে সুপ্ত মেধার স্ফূরণ ঘটানো। এ কারণে যথার্থ শিক্ষকের কাজ শিষ্যের আত্মাকে উদ্বোধিত করা এবং তার অন্তর্নিহিত সকল প্রচ্ছন্ন শক্তিকে ব্যক্ত করে তোলা। একজন আদর্শ শিক্ষক ছাত্রদেরকে শিক্ষা দেন যে বিষয়গুলো তা হল-জাতীয় দর্শন,রাষ্ট্রীয় আদর্শ,অর্থনৈঈতিক অবকাঠামোগত অবস্থা,সামাজিক অবকাঠামোগত অবস্থা,জাতীয় ঐতিহ্য,জাতীয় ইতিহাস,জাতিগত মূল্যবোধ, জনগণের ধর্মীয় চেতনা ও বিশ্বাস, সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত, জনগণের সমকালীন জীবনব্যবস্থা,শিক্ষার্থীর সমকালীন চাহিদা, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ চাহিদা সমাজের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ড, সমাজের জরুরী চাহিদা ইত্যাদি।
৩.
শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, মহান ব্রত। এ ব্রত পালনে শিক্ষককে হতে হয় নৈতিক আদর্শে উজ্জ্বল। যিনি শিক্ষার্থীর হূদয়ে জ্ঞান তৃষ্ণা জাগিয়ে, মনের সুকুমার বৃত্তিগুলোর পরিচর্চা করে শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষে পরিণত করেন তিনিই শিক্ষক। আমাদের দেশে আদর্শ শিক্ষকের বড় অভাব। সততা, নৈতিকতা, উদারতা, আধুনিকতা, ব্যক্তিত্ব তথা সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষকই আদর্শ শিক্ষক। কেবল শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করাই শিক্ষকের দায়িত্ব নয়; তিনি শিক্ষায় নীতি-নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও আদর্শ মূল্যবোধ শিক্ষার্থীর মাঝে ছড়িয়ে দিবেন। শিক্ষক সম্পর্কে উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ডের বিশ্লেষণ সত্যিই যথার্থ। তিনি বলেন- "একজন সাধারণ শিক্ষক-বক্তৃতা করেন, একজন ভালো শিক্ষক-বিশ্লেষণ করেন, একজন উত্তম শিক্ষক-প্রদর্শন করেন, একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক-অনুপ্রাণিত করেন।" আর্থার ওয়ার্ডের দৃষ্টিতে উত্তম ও মহান শিক্ষকের সকল বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান ছিল যার মধ্যে তিনি হলেন ফেনী জেলার মধ্যে কিংবদন্তীতুল্য শিক্ষক, শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ সিলোনীয়া হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মরহুম আবদুল ওয়াহাব বিএসসি স্যার। যিনি ওয়াহাব বিএসসি হিসেবে সমধিক পরিচিত।তিনি ছিলেন একজন মহান শিক্ষক। শিক্ষাকে তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। এটি তাঁর কাছে কোন পেশা ছিলোনা। আমি সিলোনীয়া হাই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত ফাস্ট বয় ছিলাম তাই স্যারের সান্নিধ্যে অনেক বেশী আসার আমার সুযোগ হয়েছিল। একদিন স্যার কথা প্রসঙ্গে যে কথাটি বলেছিলেন তাতে তিনি যে শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন তা ফুটে উঠে। তিনি বলেছিলেন, " সিলোনীয়া হাই স্কুল ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ সময় এত শিক্ষক ছিলো না,এত বিল্ডিং ছিলোনা, অবকাঠামোগত এত উন্নয়নও ছিলো না কিন্তু ঐ সময় ছাত্ররা অনেক ভালো রেজাল্ট করতো। বর্তমানে শিক্ষক বেড়েছে অনেক, অবকাঠামোগত উন্নয়নও চোখে পড়ার মতো কিন্তু এখন আর ঐ সময়ের মতো রেজাল্ট নাই। কারণ ঐ সময় আমরা পড়াতাম আর এখন শিক্ষকরা চাকুরী করে। " আসলে তাই শিক্ষকতাকে চাকুরী মনে করলে হবে না। আর চাকুরী মনে করলে মহৎ কোন কাজ করা যায় না। অন্য কোন বিষয় না হলেও শিক্ষার ব্যাপারে সবাই পরামর্শ দেয় এ বিষয়টাকে স্যার খুব খারাপ দৃষ্টিতে দেখতেন। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন অন্য কোন পেশার ক্ষেত্রে এটা দেখা যায় না। একজন ডাক্তার যখন উকিলের কাজে যায় তখন ডাক্তার উকিলকে বলে না যে আমার মামলাটা এভাবে দেখেন, আবার উকিল যখন ডাক্তারের কাছে যান তখন বলেন না যে আমাকে এ রোগের জন্য এ ঔষধ দেন।সব পেশার লোক নিজে নিজে তার সিদ্ধান্ত দেয় কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। এ ব্যাপারে সবাই বিশেষজ্ঞ। সবাই পরামর্শ দিতে চায়। একজন ছাত্রের ব্যাপারে সব্বোর্চ পরামর্শক হলো তার শিক্ষক। তিনিই বলতে পারবেন কোন ছাত্রের কি দরকার। আসলেই তো ছাত্রের ডাক্তার হচ্ছেন শিক্ষক। তিনিই ছাত্রের সঠিক চিকিৎসা দিতে পারবেন। তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক। তিনি বলতেন যখন তখন কোন কাজ করবে না। কোন কাজ করতে গেলে প্রথমে চিন্তা করবে আগামী দশ বছর পর এর রেজাল্ট কি হবে। তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখতে বলতেন। অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন। তারপর সে অনুযায়ী সামনে এগুতে বলতেন। এ যেন মালয়েশিয়ার সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী ডাঃ মাহথীর মোহাম্মদের কথার প্রতিধ্বনি 'সিয়িং এ বিগ পিকচার এন্ড দেন প্ল্যান ফর ফিউচার'।

মহৎ প্রাণ এ শিক্ষক ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহন করেন ফেনী জেলার দাগনভুঞা উপজেলার উত্তর নেয়াজপুরের মিন্নাত আলী ভুঞা বাড়িতে। ওনার পিতার নাম সেকান্দর মিয়া এবং মাতার নাম আরবের নেছা। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারী তিনি ইন্তেকাল করেন। আজ তিনি নেই কিন্তু প্রদীপের মতো নিজেকে জ্বালিয়ে তাঁর অগণিত ছাত্রকে আলো দান করে অমর হয়ে বেঁচে আছেন, থাকবেন ছাত্রদের হৃদয়ের মণিকোঠায়। তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞানের আলো দ্বারা সংকীর্ণতার সীমারেখা ভেদ করে একটি আদর্শ সমাজ বিস্তারে যে সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন তা শিক্ষার্থীদের জীবন পথের আলোকবর্তিকা হয়ে যুগ যুগান্তরে বিরাজ করবে এবং জাতির অগ্রগতির পথকে সুগম করবে। আজ এই মহান শিক্ষকের মৃত্যুদিনে স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং মহান রবের নিকট প্রার্থনা করছি "হে আল্লাহ্ তুমি মহান এ শিক্ষককে জান্নাতের বাসিন্দা বানাও
লেখকঃব্যাংকার,
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ৯৯৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৮/০১/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast