www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

স্বামী অদ্রীজানন্দ- ৩য় পর্ব

পরের দিন সকাল হতে না হতেই, টিউশনির নাম করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, অদ্রীজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। এর পরের দিনগুলো যাতে আর নষ্ট না হয়, তার একটা ব্লু-প্রিন্ট তৈরী করতে হবে। পড়াশুনো লাটে উঠেছে বললেও কম বলা হয়।  যাই করতে যাই, পর্ণার ঐ মোহিনী হাসিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আচ্ছা বিপদে পড়া গেল দেখছি ।

নীল ফচকামি মেরে বলেই ফেলল সেদিনকে, তোতলা অর্নব নাকি মহাকবি মাইকেলের মতো বড় কবি হবে “বসন্তের বিলাপ” নামে কবিতা লিখে, ঠিক কবি মাইকেলের “রামের বিলাপ” এর অনুকরণে, আর তারপরেই তোতলাকে জিজ্ঞাসা করল, বলতো, কবিতাটার নামটা আরেকবার...  

অর্নব মুখটা বিকৃত করে, বলে উঠল, কো-ও-ও-ও-ওন টা? ......   আ-আ-আ-আমেল ...... বিলা-আ-আ-আপ? ......না-আ-আ, ...... হ-অ-অ-স-অ-ন-তো-ও-ওল......পুরো কথাটাও শেষ করতে পারেনি, স্বামী অদ্রীজানন্দ বলে উঠল, বোঝো ঠেলা, কবে থেকে বলছি, টেপরেকর্ডারটা দোকানে সারাতে দে, এই নিয়ে তুই আবার কবিতা লিখবি? তবে আমাদের বসন্তবাবুর কবিতার নামটা কিন্তু খাসা বলেছিস, ওটা বসন্তের বিলাপ না দিয়ে “হসন্তর বিলাপ” বা “বুনো ওলের বিলাপ” সব চলতে পারে।

প্রথমটা বুঝতে পারি নি, কিন্তু এইবারে যখন সকলে মিলে ঠোঁট চিপে হাসতে শুরু করল, তখন ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম, আর বুঝতে পেরেই প্রথমে তোতলাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম, আমি অপেক্ষা করে থাকব তোর লেখা কবিতার আবৃত্তি তোর নিজের মুখে শোনার, আর তারপরে পাশে বসা নীলকে এমন জোরে এক লাথি কষিয়েছিলাম যে ও সারাজীবন মনে রাখবে। লাথি খেয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল, আমি কি করব, ঐ তো অদ্রীজটাই বলল, কথাটা বলতে। আমি অদ্রীজের দিকে কটমট করে তাকাতেই, দেখি, স্বামীজী জয় শ্রী রাম বলে হনুমানের মত লাফ দিয়ে ক্লাস থেকে ধাঁ। আর তোতলা আমার কথাটা শুনে, ঘাড় গুঁজে বসে রইল কিছুক্ষণ ।

কেন জানিনা, ব্যাপারটা আমারও ঠিক সুবিধের লাগছে না, অদ্রীজ যে আসলে কি করতে চাইছে, বুঝতে পারছি না। আমার থেকে একদিকে সান্ধ্য-ভোজন নিচ্ছে, আবার অন্য কারোর থেকে, ব্যাটা আবার ব্রেকফাস্ট করছে না তো ? অন্য কাউকেও আমার মতো এই একই আশ্বাস দেয় নি তো? কিন্তু ও তো আমাকে বার দুই মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল পর্ণার সামনা-সামনি, আমিই তো বলতে পারিনি কোনো কথা, কিন্তু তবুও মনটা কেন জানিনা, কাল রাতের পর থেকে একটা কু গাইছে।

এজন্যই কলেজের বাইরে আজকে ওর সাথে একটু একান্তে কথা বলা দরকার। যতদূর জানি, জয়নগর স্টেশনের ওপারে, মুচিপাড়ায় অদ্রীজদের বাড়ি, যদিও ওর বাড়ি আমরা আগে কেউ আসি নি, আসলে বন্ধুত্বর শুরু এই কলেজ থেকেই, আগে কখনো আর সেরকম ভাবে দরকার পড়েনি, আর ও কখনো সেভাবে নিজের বাড়ির কথা বলেও নি। তবে ওপাড়ায় ওকে নাকি সকলে একডাকে চেনে, বলেছিল একবার বোধহয়, সেই ভরসাতেই যাওয়া। একবার ভাবলাম আমাদের তোতলা অর্ণবকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাই, পরক্ষণেই মনে হল, সকাল সকাল ছেলেটার মাথায় আর চাপ দিয়ে লাভ নেই, এমনিতেই গলায় প্রচুর চাপ নিয়ে ফেলেছে। তাই, একাই বেরিয়ে পড়লাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রেললাইন ডিঙ্গিয়ে, পৌঁছে গেলাম, মুচিপাড়ার মোড়ে। ওখানে গিয়ে পাশের চায়ের দোকান থেকে একটা সিগারেট ও এক ভাঁড় চা অর্ডার করে ভাবতে শুরু করলাম, এবারে কি করবো, দোকানে এইসময়ে আর কেউ নেই। ভাবতে ভাবতে দেখি, দোকানের পিছনদিকে এক বেঁটে, রাশভারী মাঝবয়সী চেহারার লোক খালি গায়ে, বারমুডা পরে উল্টোদিকে মুখ করে বসে কি যেন করছে। গায়ের রঙ আলকাতরার মতো উজ্জ্বল, ভাবলাম ইনিই বোধহয় মালিক, এনাকেই জিজ্ঞাসা করে দেখা যাক, পিছন থেকে দেখেই বুঝতে পারলাম, যে মহাভারতের যুগে হলে নির্ঘাৎ একেই ঘটোৎকচের ভাই বলে চালানো যেত। হাসি মনে চেপে লোকটাকেই জিজ্ঞাসা করলাম- আচ্ছা কাকু, অদ্রীজ বলে কাউকে চেনেন এখানে? কোনো উত্তর নেই, কি রে বাবা, কালা নাকি? আরো একবার জিজ্ঞাসা করে দেখা যাক! আরো একটু কাছে গিয়ে শুনলাম উনি বিড়বিড় করে “আমাদের ছোট নদী” কবিতাটা বই দেখে পড়ে যাচ্ছেন। নির্ঘাত পাগল । কিন্তু আমার উপায়ও নেই, তাই আর একবার গলা খাঁকারি দিয়ে যেই না জিজ্ঞাসা করেছি, কাকু, ও কাকু এখানে অদ্রীজ বলে কোন ছেলেকে জানেন?

ব্যস অমনি দেখি, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে মুঠো বন্ধ করে এক জোরদার ঘুঁসি পুরো শরীর নিয়ে ঘুরিয়ে চালিয়ে দিল আমার নাক লক্ষ্য করে, কিন্তু ক্রিকেটটা আমি খেলতে ভালোই পারি বলে, তৎক্ষণাৎ রিফ্লেক্সের জোরে বডিলাইন বাউন্সার সামলানোর মতো করে, মাথাটা নীচু করে দিলাম, আর তাতেই ঘটল মহাবিপত্তি। ঘুঁসি নিজের লক্ষভ্রষ্ট হওয়াতে, ঐ পাঁচ কিলো হাতের ভার মহাশয়ের পুরো শরীরকে নাড়িয়ে দিল, আর তাতেই টাল সামলাতে না পেরে ঘুঁষির মালিককে দড়াম করে ফেলে দিল মাটিতে।

আমি ভাবাচ্যাকা খেয়ে দু পা পিছিয়ে গিয়ে এই মহাপতন দেখলাম নিজের চোখে! মনে মনে ভাবলাম, ইশ!, যদি আরো দুদিন আগে অদ্রীজের খোঁজে আসতাম তাহলে, আমাদের ফিজিক্সের খাটুয়া স্যর, যিনি ছাত্রমহলে, খাটিয়া স্যর নামে সমধিক পরিচিত, তার হাতে কানমলা খেতে হত না আর।

কানমলা দিতে দিতে, বার বার স্যর বলছিলেন, আর কতবার, কতভাবে বোঝাবো তোদের যে, “এ জগতে, প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে”। ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার এমন চাক্ষুষ প্রমাণ দেখে সবে ভাবতে বসেছিলাম, নিউটন যদি আগে-ভাগেই না বলে যেতেন, তাহলে এবারে ফিজিক্সের নোবেল প্রাইজটা নির্ঘাত আমার হাতেই আসত, কিন্তু যিনি ভুপতিত হলেন, তার প্রতিক্রিয়ার জোর এমন শুরু হল যে, আমাকে সভয়ে আরও দু’পা পিছিয়ে আসতে হল।

প্রচন্ড জোরে কান্না জুরে দিয়ে বাব্বা-আ-আ-আ-আ, ডেকে কান ঝালাপালা করে দিল, এতবড় একটা লোক হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে ডাকতে গেল কেন ঠিক বোধগম্য হল না। অনেক কষ্টে টেনে হেঁচড়ে উঠে বসাতে দেখলাম, না সে কোনও, মাঝবয়েসী লোক নয়, বরং ঘটোৎকচের এক্কেবারে ছেলেবেলা। মুখ দেখে বুঝলাম, বয়স খুব বড়জোর দশ কি বারো, কিন্তু এই বয়সেই এমন দশাসই চেহারার মালিক কি করে হল, বোঝার আগেই, এক খ্যাংরাকাঠির চেহারার বয়স্ক লোক দৌড়ে এসে – ওরে আমার ঘোৎনা সোনার কে এরকম হাল করল রে, বলে বার কয়েক আপ্রাণ চেষ্টা করেও যখন ঘোৎনা সোনাকে ওঠাতে পারল না, মুখ তুলে আমাকে আমাকে দেখতে পেয়েই আমার দিকে এগিয়ে এসে কর্কশগলায় বলে উঠলেন, এই যে তুমি, তুমি করেছ আমার ঘোৎনা সোনার এই হাল?

আমার মুখ দিয়ে না চাইতেও কেন জানি না বেরিয়ে গেল- না, না, বিশ্বাস করুন আমি না, নিউটন করেছে। আমার কথায়, থমকে গিয়ে, চারিদিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে আমায় বললেন, সকাল বেলাতে মস্করা হচ্ছে, আমার সাথে? এখানে নিউটন বলে কে আছে শুনি? সে কে? কোথায়? ডাকো তাকে। আমি বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটা অন্য দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে, ওদিকে ঘোৎনাসোনাও আরো বেশী করে চেঁচিয়ে বলতে শুরু করে দিয়েছে জানো বাবা, ঐ ধাড়ি ছেলেটা আমাকে কাকু বলে ডাকছিল, ওকে ঘুঁষি মারতে গিয়েই তো পড়ে গেলাম।

আমার ইচ্ছে হচ্ছিল, কানের তলায়, ঠাঁটিয়ে একটা চড় কষাই, আরে বাবা, ঐ চেহারা নিয়ে তুই যদি মাটিতে পড়িসও, তবে আগে তো দেখতে হবে, মাটিটা কতটা ফাটল ধরল... কিন্তু আর কথা বাড়াব না বলে, চলে যেতেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু লোকটার অভদ্র ব্যাবহার বেড়েই গেল, পিছন থেকে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে বললেন, আমার ছেলের চেহারাটার কি অবস্থা করেছ তুমি? অ্যাঁ? ওকে দেখে তোমার কাকু বলে মনে হয়েছে ? কি হাল হয়েছে ছেলেটার, দেখলেও কষ্ট লাগছে।

আমার মুখও এবারে আমার সাথে বিট্রে করে বসল, কিছুতেই চুপ থাকল না, বেশ রুক্ষ স্বরে বলেই ফেলল, ভুল হয়ে গেছে মশাই, সত্যিই বুঝতে পারিনি আগে, তবে এবারে বেশ বুঝতে পেরেছি। চোখ গোলগোল করে লোকটি বলে উঠলেন- মানে? কি বলতে চাও হে ছোকরা তুমি? আমি বলেই ফেললুম, আপনার ছেলেকে এখানে রেখেছেন কেন? যাদুঘরে দিয়ে দিন, সাথে পারলে আপনিও যান , আপনাকে আর আপনার ছেলেকে পাশাপাশি রেখে দুর্ভিক্ষের ফলাফল ও কারণ দুটোই বেশ ভালো বোঝাতে পারবে যাদুঘর কর্তারা। ভদ্রলোক ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগেই আমি চা আর সিগারেটের মায়া ত্যাগ করে দৌড়ে দোকান ছেড়ে সাইকেল নিয়ে আবার অদ্রীজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লুম।

কিছুটা গিয়ে চোখে পড়ল, আবার একটা দোকান, সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে আগের বারের এক্সপিরিয়েন্স অনুভব করে ঢুকব কি, ঢুকব না এই ভাবছি, হঠাৎ দেখি, কাঁধে কাঁধে হাত রেখে মুখ মুছতে মুছতে স্বামী অদ্রীজানন্দ নিজের সাথে ঐ অমিয় ছোঁড়াটাকে নিয়ে দোকান থেকে বেরোচ্ছে। সকালের জলখাবারটা ভালোই হয়েছে দুজনের বলেই মনে হল, তার মানে আমাকে আশায় রেখে, এখানে অমিয়র সাথে গুটি সাজানো হচ্ছে, এবারে বুঝতে পারলাম, হঠাৎ কোথা থেকে মালটা পর্ণার সাথে জুড়ে বসেছে। এরকম একটা দৃশ্য দেখার জন্য আমি একেবারেই তৈরী ছিলাম না, রাগে, দুঃখে, ঘৃণায়, শরীর রি রি করে উঠল, হ্যাঁ, এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা, আমার সাথেই? এই আমি অদ্রীজকে বিশ্বাস করে এতকিছু করলাম ! এইজন্যই এখনকার স্বামীজীদের প্রতি আমার বিশ্বাস শূন্য ছাড়িয়ে মাইনাসের দিকে নেমে গেছে।

আরো আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম, যখন কোন ভাবান্তর দেখলাম না ওদের কারোরই মুখে, আমাকে দেখে,  দুজনেই কেমন নির্লজ্জ ও বেহায়া দেখো, পুরো থার্টি টু অল আউট করে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে এসে অমিয় হাসতে হাসতে বলল -এই যে, বসন্তবাবু, আমি যেন আর তোমাকে পর্ণার পেছনে ঘুরঘুর করতে না দেখি, পর্ণা আমার, আমার সাথে অদ্রীজেরও কথা হয়ে গেছে, ও এবারে কিছু করলে আমার জন্য করবে। পর্ণা শুধু আমার, শুধুই আমার!!  

রাগে, অপমানে কিছু বলতে পারলাম না, চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে এলো, অদ্রীজ পাশে দাঁড়িয়ে খ্যা খ্যা করে হেসে যাচ্ছিল, আমি কোনোরকমে চোখের জল লুকিয়ে, দুজনের দিকে তাকিয়েই থ্যাংক ইউ বলে চলেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু পিছন থেকে অমিয়, আমার সাইকেলের ক্যারিয়ারটা টেনে ধরে রাখাতে সাইকেলটা নিয়ে আর এগুতে পারলাম না। অদ্রীজ হাত ধরে বলে উঠল, একি রে, বসন্তবাবুর চোখে তো দেখি জল, দেখ দেখ অমিয়, দেখ। আহারে, বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে পর্ণাকে। চল আমরা একে নিয়ে আমাদের বাড়ি যাই। অমিয় আমার সামনে এসে বলল, তুই একটা পাক্কা গামবাট বুঝলি? আমি বললাম বলেই সব ছেড়ে দিয়ে চললি? আমি তো মজা করছিলাম। চল, অদ্রীজের বাড়ি চল, অনেক কথা আছে।

সকাল থেকে আমার অবাক হবার পালা চলছেই, এটাও নতুন যোগ হল, আমি আর অমিয়, এক সাথে অদ্রীজের বাড়ি যাচ্ছি, তাও গল্প করতে করতে, এরকম হবে কোনোদিন ভেবেছিলাম? এর চাইতে সহজ চিন্তা বোধহয় ছিল মঙ্গলগ্রহে প্রাণের দেখা মেলা আশা করা।

শুকনো মুখে অদ্রীজদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছালাম। দেখলাম ঠিক বাড়ি বলতে আমরা যা বুঝি সেরকম গোছানো নয়, একতলা পুরোনো বাড়ি, দুটো ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম আর সামনে একচিলতে বারান্দা। দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে, টালির ছাদ, বাইরেও ইট দেখা যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে, অনেক দিন ধরে কোনো সারাই হয়না, যা অদ্রীজের সাবলীল, সহজ ও হাসিখুশি ইমেজের সাথে ঠিক খাপ খাচ্ছে না। কাকিমা, মানে অদ্রীজের মা আমাদের দেখে রুটি ও বেগুন ভাজা বানাতে বসে পড়লেন, না করা সত্ত্বেও মানলেন না, বললেন গরীবের বাড়িতে এসেছ যখন, তখন কিছু না খাইয়ে ছাড়লে যে অমঙ্গল হবে বাছা !  

কথায় কথায় বুঝতে পারলাম, অদ্রীজের বাবা, দুবছর হল, ক্যান্সারে গত হয়েছেন, এবং নিজের সাথে সাথে এই সংসারের সমস্ত সুখও নিয়ে চলে গেছেন। অদ্রীজের টিউশনি, জমি-বাড়ির দালালীই নাকি একমাত্র আয়ের পথ, জমানো যা ছিল, সব বাবার চিকিৎসায় খরচা করে ফেলেছে। মা-ছেলে অর্ধেক দিন কপর্দকশূণ্য অবস্থায় কাটায়। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম এই ভেবে শুধু, এত কষ্ট সহ্য করেও কি করে এত হাসি মুখে থাকে ও? কখনো কোনো অভিযোগ বা অনুযোগ ওর মুখে শুনতে পাই নি, আমি নিজের কথা ভুলে গিয়ে, ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই কি করে আনিস তোর মুখে ঐ হাসি? কি করেই বা অন্যদের হাসাস? এ কি হাল তোদের ?

এই প্রথমবার অদ্রীজ গম্ভীর হয়ে বলল- বসন্তবাবু, জানিস একসময় আমিও কষ্টের সাথে লড়াই করতে করতে যখন হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, হঠাৎ একদিন স্বপ্নে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেব দেখা দিয়ে বললেন, ওরে পাগল, তুই যত কষ্ট পাবি, দুঃখে ভাসবি, তত লোকে তোকে আরো, কষ্ট দেবে, দুঃখ দেবে, তোকে এ সমাজে বাঁচতে দেবে না, আমার কথা শোন, কষ্ট- দুঃখকে হার মানাবার একমাত্র ঔষধ হল হাসি, নিজে হাসতে শেখ ও অন্যকেও হাসা তাহলে দেখবি এই প্রাণখোলা হাসিই তোর রক্ষাকবচ হবে, লোকে তোকে হয় ভালবাসবে অথবা হিংসে করবে, কিন্তু কষ্ট বা দুঃখ দিতে পারবে না। কারণ লোকে জানতেই পারবে না তোর ভিতরে কতটা কষ্ট আছে, কতটা দুঃখে তোর জীবনে রাখা আছে, আর একবার অভ্যাস রপ্ত করে নিলে দেখবি, দুঃখ ও কষ্ট সব পিছন ফিরে পালাবে। এই বলে আবার সেই পেটেন্ট নেওয়া অট্টহাস্য করে বলে উঠল, যাক গে ছাড়, আমার কথা ছাড়, আসল কথা শোন, এবারে একটা জব্বর প্ল্যান করেছি, আমি আর অমিয় ...

কেন জানি না, আমার মনটা আর ভালো লাগছিল না, মনে হচ্ছিল, এসব কথা এখন আর না হলেই ভালো, আমি বললাম- ছাড়, ওসব পরে দেখা যাবেখন। আজকে আর ভালো লাগছে না। কিন্তু অমিয়টা নাছোড়বান্দা, বলল, দেখ বসন্ত, এরপরেও আর যদি তুই না এগুতে পারিস, তাহলে কিন্তু বাপু আমি আর টানতে পারব না, আমিও রণে ভঙ্গ দেব এই বলে রাখছি,  ব্যাপারটা বোধগম্য হল না,  আমার জন্য অমিয় ... বুঝতে পারলাম অদ্রীজের কথায়, বলল, দেখ পর্ণার সাথে বন্ধুত্ত্ব ও আমার কথামতোই করেছে শুধু তোর জন্য। যাতে ওর ভালো-মন্দ, চাওয়া-পাওয়া সব বুঝে এগুনো যায়। বিশেষ করে ওর মনে তোর প্রতি ভালোবাসার বীজ বপন করাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু সেটা খুব গোপনে করার দরকার ছিল। আর আজ সে অনেকটাই সফল ভাবে করেছে।  

মানে? স্পাই? তুই স্পাইগিরি করছিস আমার হয়ে ? আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম অমিয়কে, উত্তরে ও একগাল হেসে বলে উঠল, অদ্রীজের কথামত ও যে কোন কিছু করতে পারে, ওর জীবনে অদ্রীজের গুরুত্ত্ব অনেক। নিজের রক্ত দিয়ে ওর মায়ের জীবন বাঁচিয়েছিল অদ্রীজ, তাই অদ্রীজের কথা ও কোনওমতেই ফেলতে পারে না। অদ্রীজকে অমিয় নিজের দাদা কাম প্রিয়বন্ধু ছাড়া ভাবতেই পারে না, অদ্রীজের কথাই, ওর কাছে শেষ কথা।  

সাথে সাথে আমিও গদগদ গলায় বলে উঠলুম, ঠিক, আজ থেকে আমিও তোর দলে নাম লেখালাম রে ভাই। জীবন থাকতে যদি কিছু পারি অদ্রীজের জন্য আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। অদ্রীজ পিঠে হালকা চাপড় মেরে বলল, দেখেছিস এই ভালোবাসা পেলে, আর দুঃখ, কষ্ট কাউকে কাবু করতে পারে রে? আমিও তাই নিজের দুঃখ, কষ্ট ভুলে গেছি আজ তোদের পেয়ে। আমি পরিষ্কার লক্ষ্য করলাম, অদ্রীজের চোখের কোণা দুটো চিকচিক করে উঠল, চকিতে হাত দিয়ে তা মুছে নিয়েই বলল, আচ্ছা শোন, আজকের প্ল্যানটা, আজ পর্নার বাড়িতে নোটস নেবার অছিলায় অমিয় বিকেলে যাবে, সাথে আমরাও থাকব, তবে আমরা ওর বাড়িতে যাব না, আমরা দূর থেকে লক্ষ্য রাখব, অমিয়কে ছাড়তে পর্ণা গেটের কাছে আসলে, আমরা আমাদের মিশন শুরু করব।

এতক্ষণ বেশ দুঃখেই ছিলাম, কিন্তু এসব শুনে আবার মনটা আবার ভালো হয়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তা'তো বুঝলাম, তবে মিশনটা কি? উত্তরে অদ্রীজ পকেট থেকে একটা রুলটানা কাগজ বার করে আমাকে দেখাল, আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম ওটা একটা রাফ প্রেমপত্র। আমার নামে বেশ গুছিয়ে অনেক জল মিশিয়ে এটা তৈরী করেছে অদ্রীজ। বলল- দুপুরে এটাকে ফ্রেশ করে রেডী করব। দেখবি, কেমন ঘ্যামচিক দেখতে লাগে। অমিয় বিদায় নিলে, আমার হিসাব মত আরো পাঁচমিনিট পর্না গে্টের কাছে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ বায়ু সেবন করে, আর ঠিক এইসময়েই, আমাদের কাজ, ওর কাছে এটিকে টিপ করে পৌছে দেওয়া, নো চিন্তা, হোমওয়ার্ক অমিয়ই করে রাখবে, বলে রাখবে তোর কথা, তুই প্রেমপত্র দিবি একটু পরে। শুধু ওর পায়ের কাছে চিঠিটা পড়ার অপেক্ষা, তারপরে আর কে দেখে, তোর কাজ হাসিল...আর আমারো মুক্তি।

অ্যাঁ, মুক্তি মানে, কিসের মুক্তি? কে দেবে তোকে মুক্তি ? আমি হেসে বলে উঠলাম, আমার সাথে সাথে ওরা দুজনও হেসে উঠল। তারপরে ঠিক হল আজকে কেউ আর কলেজ যাব না, দুপুরে, আবার অদ্রীজের বাড়িতে আসতে হবে। এখান থেকে আমরা আমাদের মিশন শুরু করব।

অদ্রীজের বাড়ি থেকে কাকিমার হাতের রুটি-বেগুনভাজা সাঁটিয়ে আবার বাড়ির দিকে যখন রওয়ানা দিলাম, দেখলাম, মনের মধ্যের সেই দমবন্ধ ভাব অনেকটাই কেটে গেছে।  ছিঃ ছিঃ আমি অমিয়কে কি ভাবছিলাম আর ও কি বেরোল, কাজ হয়ে গেলে ওরও একটা খাওয়া পাওনা...এতদূর ভেবেও আবার পকেটের কথা মনে পড়াতে, ভাবলাম, না থাক, আর পকেটের উপরে আর চাপ দিয়ে লাভ নেই, ওর কাছে বরঞ্চ ক্ষমা চেয়ে নিলেই হবে। আর স্বামী অদ্রীজানন্দ, ওকে নিয়ে আর কিছুই বলার নেই, এরকম ভাবে কেউ নিঃস্বার্থ ভাবে আমার হেল্প করছে, ভাবলেও নিজেকে একটা কেউকেটা মনে হচ্ছে। এত প্ল্যান ব্যাটার মাথার মধ্যে কিলবিল করছে, ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয় নি!...কি ছেলে রে বাবা? মনে মনে শ্রদ্ধার সাথে বলে ঊঠলাম-  হ্যাটস অব ইউ স্বামী অদ্রীজানন্দ !!  


( ক্রমশঃ )
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২২০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/০২/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • রুমা ঢ্যাং ২৩/০২/২০১৬
    জীবন দর্শনের কথাগুলো পুরো গল্পের সঙ্গে বেশ ভালো লেগেছে। দারুন লাগলো
  • আজিজ আহমেদ ১৮/০২/২০১৬
    কমেডী অনেক রকমের হয়।
    শান্তনু তোমার কমেডী হলো, পরিস্থিতির বর্ননায়। হাসির শব্দের ব্যবহার গুলো খুব ভাল এবং দেহাতি।
    বেশ মজার। Stick on to comedy.
  • ধ্রুব রাসেল ১৮/০২/২০১৬
    দাদা এই পর্বও বেশ লাগলো। লিখে যাও।
  • বাহ। চমত্কার। গল্পটায় একটা নতুন মাত্র যোগ হলো। এই মানবিক দিকের সঠিক ব্যবহার গল্পটাকে ক্লাস দিচ্ছে।
    গরিবখানা কথাটা পাল্টালে ভালো।
  • নির্ঝর ১৮/০২/২০১৬
    সহমত
 
Quantcast