www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আমাদের ‘আমরা’ হয়ে উঠা

গল্প : আমাদের ‘আমরা’ হয়ে উঠা
চাঁদের বেজায় মনখারাপ। ভীষণ কান্নাকাটি; নাকের পানি, চোখের পানি মিলেমিশে যাচ্ছে তাই অবস্থা। ব্যাপার কী? চাঁদ বলে, ‘রিয়া (Rhea) কে দেখো। কী চমৎকার ওর প্রভু! কী তাঁর গায়ের রং! রঙ্গিন কতকগুলো বলয়ও আছে আবার। নামটাই যা একটু বিদঘুটে, শনি (Saturn)। এদিকে ইউরোপাকে (Europa) দেখলেতো আমি হিংসায় অজ্ঞান হয়ে যাই। কী বিশাল ওর প্রেমিক! মহাশক্তিধর হারকিউলিসের মত। কী সুন্দর গালভরা একটা নামও আছে, জুপিটার। আর এত সুন্দর আমি, কপালে জুটেছে এই কুৎসিত পৃথিবী - দ্য আর্থ’। আহারে! কী কষ্ট! রাগে-দুঃখে চাঁদ তাই কিছুদিন পরপর আলো দেয়া বন্ধ করে দেয়। তাইতো পৃথিবীতে আমরা অমাবশ্যা পাই। চাঁদ কতদিন ভেবেছে ঘুরতে ঘুরতে একদিন পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেড়িয়ে চলে যাবে অসীম মহাশুন্যে। তারপর ভাসতে ভাসতে যাবে গ্যালাক্সি থেকে গ্যালাক্সি পার হয়ে আরও দূরে। নিশ্চয়ই সেখানে পৃথিবীর চেয়েও সুদর্শন সঙ্গী পাওয়া যাবে।
কিন্তু চাঁদের একটা সমস্যা আছে। হ্রদয় জুড়ে শুধুই মায়া আর মায়া। মায়ার খেলায় অবরুদ্ধ যেন! এ মায়ার টানেই সে ছাড়তে পারে না পৃথিবীর বন্দিত্ব। না, পৃথিবীর উপর তাঁর কোন মায়া নেই। চাঁদের মায়া কুৎসিত পৃথিবীর অদ্ভুত কিছু মানুষের উপর। এরা কারণে-অকারণে সারাক্ষণ কেমন সতৃষ্ণ নয়নে শুধু তাঁর দিকেই তাকিয়ে থাকে। চাঁদের যে এ অপলক বুভুক্ষু দৃষ্টি উপেক্ষার ক্ষমতা নেই। তাই আলো বন্ধ করে দেবার পরও নড়েচড়ে একটু বাঁকা হয়ে দেখার চেষ্টা করে ঐ মানুষগুলোকে। তারপর আরেকটু বড়। মানুষগুলোর মুগ্ধ দৃষ্টি যতই ভাল করে দেখতে চায় ততই একটু একটু করে বড় হতে থাকে সে। একসময় পূর্ণ-বিকশিত হয়ে বিস্ময়ে দেখে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকা ঐসব মানুষের সতৃষ্ণ দৃষ্টি। অগণিত বিস্ফারিত নয়নযুগলধারী মানুষের একজন হওয়ার স্বপ্নে বিভোর আমি ছোটবেলা থেকেই। উথালপাথাল জ্যোৎস্নায় স্বপ্ন দেখা তাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে অবিরত।
স্বপ্ন আমি দেখতেই পারি। ওইটা তো আর কারো কেনা নয়। স্বপ্ন বাকিংহাম প্যালেসও না যে ব্রিটিশ কুইনের অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হবে। আমি নিরন্তর স্বপ্নে ঢুকে যাই, সময়ে অসময়ে। ডঃ ইউনুসের দারিদ্র বিমোচনের স্বপ্ন ফেরি করি না। আমি অলীক স্বপ্ন দেখি। রাতে দেখি, দিনেও দেখি। বাহিরে হিম শীত পরেছে। ঘরের হিটারটাও কমিয়ে দেয়া। রুমভর্তি ঠান্ডা-ঠান্ডা আবহ। তুষারশুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে সে। কেমন গুটিসুটি, কুঁকড়ে আছে। মায়ের জড়ায়ুতে গুঁজে থাকার মত। আলসে গন্ধ দেহের প্রতিটি কোষে। ঘুমের মাঝেই মুখে রাজ্যের সব ভাবনা খেলা করছে অলক্ষ্যে, অজান্তে। পাতলা কম্বলটা কাঁধ ছেড়ে নেমে গেছে। হালকা শীতের প্রকোপে মৃদু কাঁপছে ঠোঁট দু’খানি, ঈষৎ নীলাভ। এলোমেলো কাজলকালো চুল বিছানাজুড়ে ছড়িয়ে আছে। চুলের কিয়দংশ কপোল ছুঁয়েছে, ছুঁয়েছে কানের শেষ পর্যন্ত। হাতখানি ঘুমের ঘোড়েই বৃথা চেষ্টা করছে, বেয়াড়া চুলগুলো সরিয়ে দিতে।
আমি পিপাসিত নয়নে তাকিয়ে থাকি। কী খুঁজছি তা নিজেই জানি না। তবে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছে। আচ্ছা! পুরো একটা জীবন কি পার করে দেয়া যায় না, এখানে বসে। আমি সযতনে অতিনিঃশব্দে ঈষৎ কম্পমান হাতে বেয়াড়া চুলগুলোকে যথাস্থানে রেখে দিব। ঘরের হিটিংটা একটু বাড়িয়ে দিব। কম্বলটা গলাঅব্দি টেনেও দিব। ইতোমধ্যে কপালে নিশ্চয় আলতো ছোঁয়া-টোয়া লেগে যাবে। বিড়ালের মত একটু নড়াচড়া হবে, আরো কুঁকড়ে যাবে শরীর। মুখ দিয়ে প্রায় না শোনার মত একটু আওয়াজ হবে, উঁয়।
ছোটবেলা থেকেই স্বপ্নে-জাগরণে চেনা-নাচেনা কেউ উঁকি দেয়। আমি বিভ্রমে পড়ি। উদ্ভ্রান্ত মজনু হয়ে যাই। প্রায় দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ। সন্ধ্যা ছুই ছুই। চারিদিকে গোধুলীর আলোছায়া। মজনু চিন্তিত, উদ্ভ্রান্ত হয়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে অসম পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছে। কোনদিকেই খেয়াল নেই। এ মজনুর দাড়ি আছে। হালের মজনুরা মডার্ন, দাড়ি রাখে না। তো সাবেক মজনু হঠাৎ শুনতে পেল কেউ একজন বলছে, ‘এই ব্যাটা থাম’। মজনু থমকে দাড়িয়ে শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখে এক বয়স্ক লোক মাথায় টুপি, গায়ে পাঞ্জাবী। নামাজ পড়ছিল। রাগত গলায় উচ্চস্বরে বলছে, ‘এই, এদিকে আয়।‘
মজনু এলেবেলে পায়ে লোকটির কাছে গেল, ‘কী হয়েছে, চাচা?’ গলায় ফাঁটাবাঁশের উচ্চস্বরে লোকটি বলে, ‘কানা নাকি তুই? চোখে দেখিস না? আমি নামাজ পড়ছি আর তুই সামনে দিয়ে হেঁটে গেলি। আমার এবাদতের ব্যাঘাত করলি। নামাজের সামনে দিয়ে গেলে পাপ হয়। তুই পাপ করেছিস, তুই পাপী।‘
‘ও, এই কথা’, মজনুর দুর্বল স্বর, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে চাচা। আসলে দেখতে পাই নি, অন্যমনস্ক ছিলাম। দয়া করে মাফ করে দেন’। লোকটি তাঁরস্বরে চিৎকার করেই যাচ্ছে, ‘কীসের মাফ! এরকম একটা খোলা মাঠে আমাকে দেখিসনি, এটা বিশ্বাস করা যায় না। নামাজের সামনে দিয়ে যাওয়া আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তোর বিচার হবে’। মজনু চোখ তুলে লোকটির দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে দীপ্ত কণ্ঠে বলে, ‘আমি সামান্য একটা মানবী লায়লার প্রেমে অন্ধ হয়ে দিক্বিদিক ভুলে নামাজের সামনে দিয়ে চলে গিয়েছি, আপনাকে দেখতে পাইনি। আর আপনি সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রেমে পরে তাঁর এবাদত করছেন। আপনি এ সময় আমাকে দেখলেন কেমন করে? এ কেমন প্রেম আপনার?’ চাচা হতবাক!
বাস্তবে এরকম মজনুপ্রায় জীবন আমার শুরু হয় অনেকদিন পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে ছাত্রজীবন শুরু করেছি। পড়াশুনা ছাড়া অন্যসবে অজ্ঞানপ্রায় তখন। প্রেম-ভালবাসা তালিকার উপরের দিকে। শফিক রেহমানের কল্যাণে ভালবাসা দিবস এসে পরে একদিন।
ভালবাসা দিবসে কিংবদন্তী সব প্রেমের কথা মনে পড়ছে। রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড বৃটিশ সিংহাসন ছেড়েছেন। বাংলাদেশের মত মুসলিমপ্রধান দেশে ফেরদৌসি আর রামেন্দু পুরোটা জীবন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কাটিয়ে দিলেন। শাহজাদা সেলিম তাঁর বাবার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন আনারকলির প্রেমে মত্ত হয়ে। রোমিও-জুলিয়েট শাশ্বত প্রেমের অপর নাম। শুধু মানব-মানবীর প্রেম না, অন্য প্রেমও আছে। ডঃ জাফর ইকবাল স্বপ্নের দেশ আমেরিকা ছেড়ে সিলেটে থাকেন, দেশকে ভালবাসেন বলেইতো। বিজ্ঞানের প্রেমে আর্কিমিডিস উদোম শরীরে চৌবাচ্চা থেকে নেমে প্রাসাদের দিকে দৌরাতে থাকেন আর বলেন, ‘ইউরেকা, ইউরেকা’। দুস্থের প্রেমে মত্ত তেরেসা সকলের মাদার হয়ে গেছেন। শান্তির প্রেমে মাত্র ২৯ বছরের টগবগে তরুণ রাজকুমার সিদ্ধার্থ রাজ্য ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে ধ্যান করেন, বুদ্ধ হতে।
ভালবাসার সেকি চৌম্বকীয় আকর্ষণ! আমার জীবনেও ঘটেছিল চব্বিশ বছর আগে। মাত্র বিশ বছর বয়সে এমনি একজন কালো একটা ফুলহাতা পোষাক পরে, প্রায় খালি হাতে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে সবকিছু ছেড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চাল-চুলোহীন আমি সে ডাকে কীভাবে সাড়া দিয়েছিলাম এখন তা ভাবলে নিজেকে আলেকজান্ডারের চেয়েও বীর মনে হয়। এরপর সুখে-দুঃখে দীর্ঘ চব্বিশটি বছর পেরিয়ে গেছে। জয়তু ভালবাসা! নিবেদন করছি মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কিছু গল্প, সে সময়ের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি, বিশেষ করে হলের চৌকাঠ পেরোয়নি তাঁদেরকে কিছুটা দুর্ভাগা বলা যেতে পারে। সদ্য কৈশর-পেরোনো মানুষের যা যা লাগে সব থরে-থরে সাজানো আছে এই চত্বরে, এর পরতে পরতে। যার যা প্রয়োজন শুধু হাত বাড়ালেই চাহিবা-মাত্র হাজির। মাত্র মাস ছয়েকের জন্য সে মহা-সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তথন বন্ধ, ৯০ এর গণআন্দোলনের রেশ চলছে। খাই-দাই ঘুড়ে বেড়াই, অতিআনন্দময় জীবন। সকালে ক্যাম্পাসে আসি, কার্জন হলের সামনের মাঠে বসে তাস খেলি আর সীমাহীন আড্ডা রাত অব্দি। বন্ধুরা আসে, যায় কিন্তু ঐ স্থান সবসময় পরিপূর্ণ থাকে। আড্ডা যেন অফুরন্ত, চিরন্তন।
একদিন দৈনিক রুটিনের সামান্য পরিবর্তন হয়। বন্ধু লিমন বলে, ‘চল আজকে সোহরাওয়ার্দি উদ্দানে যাই। কলেজের মেয়েরা আসতে পারে, মজা হবে।‘
‘রাখ তোর মেয়ে! এখানে সমস্যা কী তোর? দুনিয়াতে এই মুহুর্তে তাস খেলার চেয়ে মজা আর কিছুতে আছে?’ আমার রাগতঃ জবাব।
লিমন অনুনয় করে বলে, ‘রাগিস না, তাসতো প্রতিদিনই খেলছি। চল একটু ঘুরে আসি ওখান থেকে। আজকে কলেজগুলোয় আগে ছুটি হয়ে যাবে। নিশ্চয় কিছু ছাত্রী আসবে। ওখান থেকে এসে আবার তাস খেলা যাবে। উঠ, চলতো।‘
বাকি সবাই দেখি রাজি হয়ে আছে। অনিচ্ছাসত্যেও রওনা হতে হয় ওদের সাথে। কার্জন হল থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিন নেতার মাজারের পাশ দিয়ে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ঢুকি আমরা। শীতের দুপুর, রোদটা মিষ্টি লাগছে। উদ্যানের ভিতরে প্রচুর গাছ, কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব। উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি, একেবারে খারাপ লাগছে না। বাদাম-চা-সিগারেটের ফেরিওয়ালারা হাঁক দিচ্ছে, ‘মামু কিছু লাগবে’। রাতের ভাসমান পতিতাদের কেউ কেউ বসার বেঞ্চিতে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। রাতের জন্য প্রস্তুত হতে হবে যে!
এখন ভাবি কী কুক্ষণে যেন সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ঢুকেছিলাম আমরা পাঁচবন্ধু সেদিন। অকস্মাৎ অজানা-অচেনা পাঁচজন তরুণীর সাথে দেখা হয়ে গেল। রীতিমত বিস্মিত আমরা! পাঁচজনের জন্য যেন পাঁচজনই রেডি, একেবারে খাপে খাপ। কলেজের সাদা ইউনিফর্ম পড়া রূপবতী মেয়েগুলোকে ঠিক সাদাপরীর মত দেখাচ্ছিল। আমরা একটু দুরত্ব রেখে ওদের পাশে গিয়ে বসি। এটা-ওটা মন্তব্য করি, এখনকার ভাষায় বলে ইভটিজিং। মেয়েগুলো ভীষণ বিরক্ত হয়। একসময় উঠে রমনা পার্কের দিকে হাঁটতে থাকে। আমরাও সেরাম নাছোড়বান্দা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র একেকটা মহাভারতের দুর্যোধন যেন – ‘বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সুচ্যগ্র মেদিনি।‘ সাদাপরীদের ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। যথারীতি পিছু নেই ওদের।
সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের গেট পার হচ্ছে ওরা। আমরা ঠিক পিছনে। ওদের মধ্যে একজন বেশ সাহসী। অতীব সাহসের একটা কাজ করে ফেলল তখন। পরে জেনেছিলাম মেয়েটির নাম বেবী। তো বেবী বীর দর্পে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলে, ’আপনারা আমাদের পিছু নিয়েছেন কেন? আর আজেবাজে কথাই বা বলছেন কেন? আপনাদের কী মা-বোন নেই?’
সাহসী হতে গিয়ে বিরাট ভুলটা ওরা তখনই করে ফেলে। আমাদের তৎক্ষণাত জবাব, ’এতো পুরনো কথা। সবাই মা-বোন হলে বউ কে হবে?’ বলতে বলতে রমনা পার্কের ভিতরে ওদের একেবারে পাশে যেয়ে বসে পরলাম আমরা। যোগাযোগের একটা সুত্রতো হয়ে গেল। এরপর ন্যাঁকা সুরে গালাগাল দেয় ওরা, আমরা দেঁতো হাসি দেই। অকস্মাৎ ওদের মধ্যে একজন লিমনকে চিনে ফেলে।
আপনি লিমন ভাই না? শাহজাহানপুরে থাকেন?
হ্যা, আপনি মানে তোমাকে তো চেনা চেনা লাগছে, শম্পা না? এতক্ষণ খেয়াল করি নাই। কী আশ্চর্য! তোমরা এখানে আর আমরা কী সব করছি।
ঠিক আছে ঠিক আছে, বাদ দেন এসব। আসেন গল্প করি।
ব্যাস, ঘনিষ্ঠতা পাঁকা হয়ে গেল। লম্বা আড্ডা চলতে থাকল। বাদাম-চা-কোক ফেরিওয়ালাদের ঘুরঘুর বেড়ে গেল। ওরা জানে এখন মার্কেটিংয়ের সময়। সেলসের সুযোগ কেন হারাবে? আমার মাথায় খালি ঘুরছে কখন কার্জন হলে ফিরব আর তাস খেলব। গল্প আর শেষ হতে চায় না। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে ফনাবিহীন বন্য সাপের মত উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে থাকে। ফেরিওয়ালাদের মুফতে কামাই এক্সপেকটেশন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ওদের হাসি বৃদ্ধি পেয়ে পেয়ে মুখমণ্ডল অতিক্রম করে ফেলেছে।
একসময় শেষ হয় ম্যারাথন আড্ডার। আমরা কার্জন হলে ফিরে আসি। দিন গড়িয়ে যায়। একদিন হঠাৎ লিমন একটা ফোন নম্বর দিয়ে বলে, ‘ঐ পাঁচজনের একজন। ফোন কর।‘ এভাবেই ঘটনাচক্রে এবং দৈবক্রমে পাঁচজনের মধ্যে কোন একজনের ফোন নাম্বার আমার কাছে চলে আসে।
‘কার ফোন নাম্বার? কাকে ফোন করব? পাঁচজনের মধ্যে কোন জন?’ আমার দ্বিধা।
‘সেটা দিয়ে তোর দরকার কী? নাম্বার দিছি ফোন কর।‘ আমি আর কি করি। দু’টো পঁচিশ পয়সার কয়েন জোগাড় করলাম। সেলফোনের জগৎ তখন নয়। কার্জন হলের সাইন্স ক্যাফেটেরিয়ার টেলিফোন বুথ থেকে সবে ফোনটা দিয়েছি। ওপাশ থেকে রিনরিনে গলায় কেউ বলে উঠল, ‘হ্যালো, কে বলছেন’? যে ফোন ধরেছিল, হ্যালো বলেছিল তাঁর বর্ণনা বড় খালু দিয়েছিলেন অনেকদিন পর।
বড় খালু তাঁর এক আত্মীয়কে পাঠিয়েছেন আমার কাছে। কী একটা তদবিরের ব্যাপারে। আমি পরিবার নিয়ে তখন গোয়ালন্দে থাকি, সরকারী চাকুরী করি। খালু তাকে ঠিকানা দিয়েছেন এভাবে, ‘গোয়ালন্দ উপজেলা কমপ্লেক্সে যাবি। তারপর কাউকে জিজ্ঞাসা করবি যে এই কমপ্লেক্সের সবচেয়ে সুন্দরী ভাবী কোন অ্যাপার্টমেন্টে থাকে? ঐটাই আমার ভাইগ্নার বাসা’। মনে মনে খুশী হলেও একটু বিব্রত হই আমি।
যাহোক, সেই রিন রিনে গলায় হ্যালো শুনার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স ক্যাফেটেরিয়ার টেলিফোন বুথে ঝড় নিত্য হয়ে গেছে আমার। পঁচিশ পয়সার কয়েনের সোল এজেন্ট হয়ে গেছি। বন্ধু মুশফিকুর রহমান শিপন বায়োকেমিস্ট্রি পড়ছে। একদিন বলে, ‘বলতো হ্যাপীর কোন জিনিষটা সবচেয়ে সুন্দর’? আমি একটু বিভ্রান্ত! ‘তাতো জানিনা’, আমতা আমতা করি। ও আবার বলে, ‘আচ্ছা, হ্যাপীর কোন জিনিসটায় প্রথমে দৃষ্টি পরে’? ‘কেন চোখ’, আমার তৎক্ষণাত জবাব। আরে ঠিকইতো! এইতো কবির সেই কল্পিত চোখ, কাজলমাখা আয়ত। সুন্দরবনের মায়া হরিণ যেন অপলক তাকিয়ে!
একুনে পঁচিশটি বছর পার হয়ে গেল সেই চোখের সাথে, সুখে-দুঃখে হাসি-কান্নায়। সেই যে ‘হ্যালো, কে বলছেন?’ ঐ রিনরিনে গলা প্রতিনিয়ত বাজে আমার কানে, আজও। কানের ককলিয়ায় যেন স্থায়ী ঠিকানা গেড়ে ফেলেছে। সতের অক্টোবর, পুরো দুইযুগ হয়ে গেল আনুষ্ঠানিক বিয়ের। তবে বলে রাখছি, এহেন কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ঘটনার পরম্পরায় আমার ভুমিকা যৎসামান্যই। অল ক্রেডিট গৌজ টু হার, মানে হাপীর। সেই টেলিফোনের পর থেকে কত ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনে, কত বিচিত্র সব ঘটনায় জড়িয়ে গেছি!
এরকম একটা ঘটনার নাম দিলাম ‘অপারেশন ওয়াকি টকি’। প্লান-প্রোগ্রাম সব লিমনের। বাস্তবায়নকারী আমরা তিনজন – লিমন(ভুতত্ববিদ), হাবিব (বায়োকেমিস্ট, এখন টরন্টো থাকে) আর আমি - ‘দ্য এ টিম’। অপারেশন ওয়াকিটকি ঘটার কিছুদিন আগে আরো একটা ঘটনা ঘটে গেছে। অবশ্য একে ঘটনা না বলে দূর্ঘটনা বলাই যুক্তিসংগত। আমরা রিক্সা করে ফিরছি। হ্যাপীকে বাড্ডায় নামিয়ে দিয়ে আমি বাসায় যাব। আচমকা হ্যাপীর এক খালার সাথে রামপুরার কাছাকাছি দেখা হয়ে গেল। শত অনুনয়-বিনয় উপেক্ষা করে উনি ভয়েস-অব-আমেরিকার মত সব খবর অন-এয়ারে দিয়ে দিলেন। ফলাফল – হ্যাপীর ফোরসড গৃহবন্দিত্ব। অবস্থা এরপর চরমভাবাপন্ন – মরুভূমির ওয়েদার। তাঁর সাথে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ।
এদিকে আমার ‘বিবাগী’ উপাধী পাওয়ার ডেটা সবগুলিই চাক্ষুষ। বেসুরো গলায় সুরেলা সব সঙ্গীত ফাঁটাই। পরিস্থিতি বলছে সলতেটাতে আগুণ ছোঁয়ামাত্রই নির্ঘাত মজনু বোম্বের আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটবে, আমার মধ্যে। এহেন পরিস্থিতিতে লিমনের অসীম দয়া, ‘তোর দিকে তো তাকানই যায় না রে। একটা কাজ করি চল, হ্যাপীদের বাসায় যাই’।
বলিস কী?
‘হ্যা, আমার কাছে ওয়াকি টকি আছে। আমরা হ্যাপীদের বাসায় ঢুকে একটা ওর কাছে দিয়ে আসব। বাকীটা দিয়ে নিরিবিলি কোনখানে বসে কথা বলা যাবে।‘
লিমন, তোর মাথা ঠিক আছে তো? কেমনে দিবি, কেমনে কী?
আগে চলতো ওখানে, ব্যবস্থা একটা না একটা হবেই।
‘দ্য এ টিম’ এক বিকালে ঠিকই উপস্থিত হয়ে গেল বাড্ডাতে। বিধাতা লিমনের কথা শুনেছেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা করে রেখেছেন। না হলে হ্যাপীদের বাসায় সুন্দর করে একটা ‘To-Let’ সাইনবোর্ড লাগানো থাকবে কেন! লিমনেরতো দেঁতো হাসি, ‘কইছিলাম না, ব্যবস্থা একটা হবেই’। আরে দেখ, ঐযে মাসুম না? তাইতো, ফিজিক্সের মাসুমইতো (এখন পুলিশের ডিআইজি)। মাসুম, দোস্ত তুই এখানে? ‘আমাদের বাসাতো এখানেই। ঐযে একতলা বাসাটা দেখছোস ঐটা। তোরা এখানে কেন?‘ মাসুম হাসতে হাসতে বলে। এদিকে লিমনের হাসি এখন আকর্ণ বিস্তৃত, ‘কইছিলাম না, ইছা থাকলে উপায় হয়’।
‘সো, হেয়ার ইজ দ্য প্লান’, লিমনের হাঁক অনেকটা কম্যান্ডারের মত, ‘আমি আর হাবিব ওয়াকি টকির একটা হ্যান্ডসেট নিয়ে বাসাভাড়া বিষয়ে আলাপ করতে হ্যাপীদের বাসায় ঢুকব। লিপু তুই আরেকটা হ্যান্ডসেট নিয়ে মাসুমের বাসায় যা। আমরা মাসুমের বাসায় আসার পর কমিউনিকেশন শুরু হবে।‘ মাসুমের বাসা ওয়াকি টকির রেঞ্জের মধ্যেই আছে। আমি আর মাসুম ঐদিকে যাই। এরিমধ্যে লিমন পানি খাওয়ার উছিলায় কেমনে যেন হ্যাপীর কাছে সেটটি হ্যান্ডওভার করে ফেলেছে।
সবাই এখন মাসুমের বাসায়। হ্যাপীকে বলা আছে, বাথরুমে গিয়ে কল করবে। বহুল প্রতীক্ষিত কথোপকথোন শুরু হবে। এই যা! বাদ সাধল মাসুম নিজেই। বলে কি, ‘দোস্ত, হ্যাপীরা আমাদের পরিচিত। কী হবে না হবে কে জানে? তোরা আমাদের বাসায় বসে এই কাজটি করিস না। আব্বা জানতে পারলে বকা দিবে’। বাবার বড় ওবিডিয়েন্ট ছেলে! আমরা কি জোর করতে পারি? ঢাকা শহরের অবস্থা এমন যে নিরিবিলি বলে কোন জায়গা ছিল বা আছে, এটা ডাহা মিথ্যা। অগত্যা আবার বাড়ি ভাড়া দেখার ছলে লিমন আর হাবিব গিয়ে ওয়াকি টকি ফেরত আনে। এবং পরিশেষে চমৎকার পরিকল্পিত একটা কমব্যাট অপারেশনের নিদারুণ অপমৃত্যু ঘটে। আহারে! বিরহ-যুগ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। দেখাদেখি, যোগাযোগের আর কত দেরী পাঞ্জেরী!
এহেন বিরহ-যুগ চলমান রয়েছে। তারমধ্যে নতুন খবর - হ্যাপীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। গোলাম রসুল বা গোলাম রহমান এরকম কিছু একটা নাম হবে লোকটার। কোন একটা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি। হ্যাপীর কলেজের এক বন্ধুর কাছ থেকে নামটা পাওয়া, ঠিকানাটাও দিয়েছিল ঐ মেয়েটি। আমাদের সর্বরকম যোগাযোগ নিষিদ্ধ তখন। ঐ বন্ধুটি হল তখনকার সোশাল মিডিয়া, মানে হালের ফেইসবুক। সিদ্ধেস্বরী কলেজের গেটের কাছে সাদা ইউনিফর্ম পড়া মেয়েটির সাথে কথা হচ্ছিল। ধরা গলায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলছে, ’লিপু ভাই, দয়া করে কিছু একটা করেন। বাবার সমান এক লোকের সাথে হ্যাপির বিয়ে ঠিক হয়েছে’।
‘আমি কী করব? আহারে! হ্যাপীর বিয়ে হয়ে যাবে!’ দীর্ঘশ্বাস বের হয়।
লিমন আবার সবকিছুতেই এক স্টেপ এগিয়ে। ‘চল, ঐ ব্যাটার বাসায় যামু’।
‘বলিস কী? উনার বাসায় কীভাবে যাব? চোর-ডাকাত ভাবতে পারে।’, আমি অবাক।
‘আরে দুর! আমরা কি চুরি করতে যামু নাকি? সোজা ওনার বাসায় গিয়া হ্যাপীর বিষয়ে সব খুইলা কবি’।
বাবারে! এদ্দুরা পোলার কী সাহস (ও আসলেই চুই সাইজের)! এদিকে মিন্টু আবার বিশালদেহী, তাগড়া জোয়ান। মিন্টুর বাবা সোনালী ব্যাংকের ডিজিএম ট্রান্সপোর্ট। তাই গাড়ি কোন সমস্যা না, সোনালী ব্যাংক থেকে চলে আসবে। ড্রাইভার শাহাদাতও আমাদের অনেক দিনের পরিচিত, ঘনিষ্ঠজনের মত। শাহাদাত ভাই খুজে খুজে ব্যাংকের সবচেয়ে শক্তপোক্ত গাড়িটা নিয়া উপস্থিত হল। দুরু দুরু বুকে দুপুরের পর রওনা দিলাম আমরা, কার্জন হল থেকে।
ঘটনাটা ছিল ১৯৯২ সালের শুরুর দিকের। বনানী চেয়ারম্যানবাড়ির আশেপাশে কোথাও গোলাম সাহেবের বাসা। ঠিকানা মত রাস্তার পাশে গাড়ী রেখে শাহাদাতকে বললাম, ’গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রেডি রাখবেন, ভাই। বেকায়দা দেখলে আমরা ঝেড়ে দৌড় দিব। গাড়ীতে উঠামাত্রই দ্রুত চলা শুরু করবেন।’। লিমন তর তর করে ঐ বাড়ির দরজার সামনে হাজির, ’এই তোরা আসছ না ক্যান? তাড়াতাড়ি আয়।’ মিন্টু তখনো গাড়ীর কাছেই, কেমন অনিচ্ছা অনিচ্ছা ভাব। আমি বরাবরের মত মাঝখানে দোদুল্যমান, মানে কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না। সাহস করে শেষমেশ লিমনের পাশে দণ্ডায়মান হলাম। হাঁত-পা কাঁপছে। লিমনই বেল টিপল।
মোটা চশমা পড়া গোফওয়ালা এক লোক দরজা খুলল, ‘কাকে চাই? তোমাদের পরিচয়?’ গুরুগম্ভীর গলা। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে ভয়ে, শির শির স্রোত পুরো স্নায়ুতন্ত্রে। লিমনটার যে কী সাহস, ’আপনার সাথে একটু কথা আছে। আপনার বিয়ের বিষয়ে’। লোকটা সামান্য অবাক হোল, ’তোমরা ভিতরে আস’। লিমন তাড়া দেয়, ‘লিপু বল না’? ‘আমি কী বলব? তুইই ক’। ‘হারামজাদা’ বইলা লিমনই শুরু করল, ’মানে হইছে কি হ্যাপী নামের একটা মেয়ের সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হইছে। আমার এই বন্ধুটি ওর সাথে প্রেম করে। এখন আপনি কী করবেন সেটা আপনার বিবেচনা’। ভদ্রলোক নেহায়েত ভালমানুষ, অন্তত আমাদের কাছে। আমাদের খাওয়ালেন, গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন এবং আরো যে কাজটি করলেন হ্যাপীদের বাসায় বলে দিলেন, হ্যাপীকে তিনি বিয়ে করছেন না।
এযাত্রা রক্ষা হল ঠিকই, তবে দিনগুলি যথারীতি পার হচ্ছে নিদারুণ বিরহে। আমাদের দেখাসাক্ষাৎ নেই অনেকদিন, ক্রাইসিস তখন চরমে। বয়েলিং পয়েন্ট ছুঁই ছুঁই অবস্থা। দূর্ঘটনায় সব জানাজানি হয়ে গেছে। আমরা ভালবাসার দ্বিতীয় স্টেজে ঢুকে গেছি। কোন রকম যোগাযোগের সুযোগ নেই। দিনের পর দিন সড়ক-যোগাযোগ, টেলি-যোগাযোগ, পত্র-যোগাযোগ সব বন্ধ। সে এক দুঃসহ জীবন! তিন বন্ধু রিক্সা নিয়ে ঘুরি আর গলা ফাঁটিয়ে গান গাই, ‘বলেছিলি তুই যে আমায়/আমি নাকি ভুলে যাব/ভুলে আমি ঠিকই তো যেতাম/পোড়ামন তোরই কথা বারে বারে বেজে উঠে’। পুরো ঢাকা শহর আমাদের দিকে কেমন কৌতুহুলে তাকিয়ে থাকে। আমাদের কোন বিকার নেই, অতি-দুঃখে গেয়েই যাচ্ছি……। দুঃখের দিনতো আর আজীবন থাকে না, শেষ একদিন হবে। ‘আগুনের দিন শেষ হবে একদিন/ঝর্ণার সাথে গান হবে একদিন……।‘ শেষও হয় একদিন।
সেদিন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আনন্দ’ বাস থেকে নেমেছি, কার্জন হলে। সকালের দৈনন্দিন রুটিন শুরু হবে। সায়েন্স ক্যাফের প্রথম চেয়ারটায় গিয়ে বসব এবং যথারীতি তাস খেলব। হঠাৎ লিমনের হন্তদন্ত আত্মপ্রকাশ – উঠ তোর সাথে কথা আছে।
আরে বস না। মোটে শুরু করলাম, একটু খেইলা লই। তোর কথা পরে শুনব।
লিমন তাড়া দেয়, ‘না এখনি আয়, ভেরি ইমারজেন্সি।‘
আরে দোস্ত, দুনিয়াতে এই মুহুর্তে ব্রিজ খেলার চেয়ে ইমারজেন্সি কাজ কেউ পয়দা করে নাই। আয়, তুইও বইসা পর।
লিমন বিরক্ত হয়ে হ্যাঁচকা টানে আমারে চেয়ার থেকে উঠায়ে বলে, ‘হ্যাপী চলে এসেছে’।
‘তো কী হইছে?’
‘আরে বেটা চলে এসেছে মানে একেবারে চলে এসেছে’, লিমন কেমন গম্ভীর স্বরে বলে। আমি একটু ভ্যাবাচেকা, ‘একেবারে চলে এসেছে মানে? কী বলছিস তুই?’
সারমর্ম হোল – গতকাল সন্ধ্যায় হ্যাপী গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে বাসা থেকে চলে এসেছে। রেখে এসেছে আঁটপাতার এক বিদায়পত্র। মালিবাগে পলাশ না শিমুল নামের এক পাতাতো ভাইয়ের বাসায় এসে উঠেছে। আমারতো ফোন নাই, তাই লিমনকে বলেছে খবর দিতে। এবং লিমন ভোর সকালেই উপস্থিত। আমারতো হাত-পা কাঁপাকাঁপি,
এখন কী করব?
‘উঠ, রিক্সায় উঠ, মালিবাগ যাই আগে। পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করি।’ সারাপথ ভাবছি এইটা কী হইল, এখন কী হইবে। অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরির বিগেস্ট উলুরু রকটা যেন বুকের উপর চেপে বসেছে। রিক্সা মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার একটা বাসায় থামল। ভাবী টাইপের এক মহিলা দরজা খুলেই বললেন, ‘তুমি লিপু? আস, হ্যাপী এখানেই আছে’। কালো ফুলস্লিভ জামা পরা, রোগা রোগা লাগছে একটু। খাওয়াদাওয়া হয়নি নিশ্চয়। ডাগর চোখদুটিতে রাতের না ঘুমানোর চিহ্ন। কাজল আর জলের নির্ভেজাল লেপ্টালেপ্টি। শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ মানচিত্র এঁকেছে কপোল জুড়ে। ঠোঁট ঈষৎ কাঁপছে, তাকিয়ে আছে গভীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। না, এ দৃষ্টি উপেক্ষা করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেননি। মুহূর্তে বুক থেকে উলুরু পাথর উধাও। ধুর যা হওয়ার হবে, আমি রেডি।
১৯৯২ সালের ১৬ অক্টোবর। সারাদিন কার্জন হলে বসে বন্ধুদের লম্বা লম্বা বোর্ড মিটিং। কী করা উচিৎ এখন? একেক বন্ধুর একেক মত। মতামত শেষ হয় না আর। সেদিনের মত পুনরায় পলাশ/শিমুল ভাইয়ের বাসায় ফেরত দেয়া। পরের দিন টাটকা খবর! হ্যাপীর বাবা গুলশান থানায় কেস করেছে, আমি নাকি তাঁদের মেয়ে অপহরণ করেছি। পুলিশ আমাকে খুঁজছে। আমার তখন মাইন্ড টোটালি সেট, ‘হু কেয়ারস’। বন্ধু হাবিব ছিল আমাদের সাথে, ‘আমার বড় ভাই সুপ্রিম কোর্টের এ্যাডভোকেট। চল ভাইয়ার ওখানে যাই। উনি আইনি বুদ্ধি দিতে পারবেন।‘ উকিল সাহেব পুরো বিষয়টা মন দিয়ে শুনলেন এবং তাৎক্ষণিক জজের মত রায় ঘোষণা করলেন, ‘তোমরা ইমিডিয়েটলি বিয়ে করে ফেল’। ইয়ায়ায়াহু… দে ছুট খিলগাঁও কাজী অফিসে।
এখন ভাবতেও অবাক লাগে ঐটুকুন মেয়ের এত সাহস কোত্থেকে এসেছিল, কেনইবা হয়েছিল। আমি গুন্ডা-বদমাশ-লুইচ্চা-লম্পট কত কিছুই হতে পারি। তা না হলেও, আমি কিছু করবার পারুম না বলে তাঁরে ফেরত পাঠাতেও পারি। সে বিবেচনা তাঁর মধ্যে ছিল কিনা জানি না। এদিকে আমিওতো মহাবোকা ছিলাম! তাঁকে বাসায় ফেরত না পাঠিয়ে কী বিরাট ঝামেলায় জড়িয়ে গেলাম সে থেকে এবং দেখতে দেখতে দুইযুগ পারও হয়ে গেল! আচ্ছা, এখন যদি ঐ মুহুর্তটি আবার আসে আমি কী করব? মনে হচ্ছে, আজীবনের মহাবোকার মত পুরনো ভুলটা আবার করে ফেলব। স্কুটারে বসে ঘামতে ঘমতে কাজী অফিসে পৌঁছে গেলাম সহসাই।
সব কাজীরই দাড়ি থাকতে হবে, এর তো কোন বিধিবদ্ধ নিয়ম নাই। কিন্তু এ পর্যন্ত যত কাজী দেখেছি, বাস্তবে বা রুপালীপর্দায়, সকলের কম-বেশী দাড়ি আছেই। দাড়িবিহীন কাজী যেন গহনাবিহীন নারী। যথারীতি আমাদের এখনকার কাজীরও দাড়ি আছে। থুঁতনিতে একগাছা না, গালভর্তি চাপদাড়ি। আমরা এখন খিলগাঁও কাজী অফিসে বসে আছি। এ কাজীর আরো একটা বৈশিষ্ট্য আছে। কেমন ভাবলেশহীন নিস্পৃহ অভিব্যক্তি। এত বিরাট একটা ঘটনা ঘটছে আর উনি দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কান খোচাচ্ছেন।
আমরা দুজন যুবক-যুবতী কী-হবে-কী-হবে-না আশঙ্কায় ঠক ঠক করে কাঁপছি। আর এই ব্যাটা নিরুত্তাপ গলায় বলেই যাচ্ছেন, ছয়শত পচাত্তর টাকা লাগবে। আমার কাছে সর্ব-সাকুল্যে আছে আম্মার আলমারি থেকে চুরি করা ২০০ টাকার প্রাইজবন্ড। অবশ্য আমার একটুবাদেই হনেওয়ালা বধূর কিছু গহনাগাটি সাথে আছে। এবং উনি সরাসরি না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে বলতে চাচ্ছেন, সমস্যার কিছু নাই। নভেল-নাটকে দেখেছি, স্ত্রী তাঁর মার দেয়া শেষ একগাছি বালা স্বামীর হাতে দিয়ে বলছে ……। আমি শত হলেও পুরুষ মানুষ। স্ত্রীর দেয়া গয়না আমার পুরুষত্বে কুঠারাঘাত (না, তেল-কূপ খননের ডায়মন্ড বিটের আঘাত) লাগবে না! অবশ্য, মনে একটা ভরসা আছে, বন্ধুরা সাথে আছে না! হারামজাদারা একটা কিছু ব্যবস্থা করেই ফেলবে।
হলি কাউ! ওরা কেমনে কেমনে যেন সবকিছু ঠিকও করে ফেলল। এরামই ফাজিল, কোত্থেকে আবার মিষ্টিও যোগার করে আনল। আমার বউতো তখোনো আমার জিহ্বাকে সোয়াহাত বানায়নি। মিষ্টি খাবার মত স্বাদ, তাই আমার জিহ্বার কোন টেস্টবাডে নাই। ফাজিলরা, বেছে বেছে রঙ্গিন একখান রিক্সায়ও তুলে দিল আমাদের। হুড ফেলে দিয়ে কয়, ‘এতদিন হুড উঠাইয়া চলছোস। এখন হুড ফালাইয়া দিলাম’। হুডফেলা রিক্সা প্রিয় ঢাকার রাস্তা ধরে ধানমন্ডি পনের নাম্বারের দিকে যাচ্ছে।
রিক্সাওয়ালা নবীন, তাই উড়ে উড়ে যাচ্ছে। দু’ধারে যাই দেখি তাই মনে হয় আমাদের জন্য। ইস্টার্ণ টাওয়ারের কাছে এক মোটর মেকানিক হেসে উঠেছে। আমি পুলকিত! ও জানল কেমনে আজ আমরা বিয়ে করেছি? বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি কিছুই জানি না! পুরো দুইযুগ পরেও মনে হচ্ছে আমরা সেই কাজী অফিস থেকে বের হয়ে হুডফেলা রিক্সায় বসে আছি। গন্তব্য অনিশ্চিত! জীবন বড়ই মধুর, আনন্দময়! আমাদের মহাকাব্যিক বিয়েটা এভাবেই হয়ে গেল। কোন ছবি নেই, সার্টিফিকেট নেই, আছে শুধু ভুলতে-না-পারা স্মৃতি। স্মৃতি থাক তাতে সমস্যা নাই। তবে কোন ছবি না থাকার বিরাট সমস্যাটা হল অন্য একদিন।
অস্ট্রেলিয়ায় একটা স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। পুরো পরিবার নিয়ে যেতে পারব, মহাখুশী। তো ভিসার জন্য পেপারস জমা দিতে হবে, পরিবারের সকলের। আমি, আমার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে। শুধু মুখে বললেই হবে না যে আমার স্ত্রী। আমাদের বিবাহের প্রমাণ দিতে হবে। ইয়া মাবুদ! আমাদের বিচিত্র বিয়ের কোন ম্যারিজ সার্টিফিকেট নাই, আবার বিয়ের শেরোয়ানি-কাতান পড়া কোন ছবিও নাই। মানুষের শ’য়ে শ’য়ে হাজার হাজার বিয়ের ছবি আর দুর্ভাগা আমাদের, আছে শুধু টুকরো টুকরো স্মৃতি। তো স্মৃতি কীভাবে প্রিন্ট করে জমা দিব অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনে!
যাহোক অন্য একটি বিয়ের মজার ঘটনা মনে পরেছে। ২০০৭ সালের ঘটনা। ঢাকায় থাকি তখন। আমার এক কাজিন বিয়ে করবে। বয়সে আমার কাছাকাছি তাই সিদ্ধান্ত হোল বর আমার গাড়িতে যাবে। আমি শাহবাগের মালঞ্চে গিয়ে গাড়িটাকে নতুন বউয়ের মত সাজিয়ে আনলাম। বেশ, বিয়েসাদী শেষ। যথারীতি বিদায় বেলার ধুম কান্নাকাটি চলছে। নতুন বউ মেকাপ-চোখ-নাকের পানি এক করে গাড়িতে উঠল। আমি চালক আর আমার স্ত্রী পাশে, পিছনে কাজিন আর তাঁর নতুন বউ - ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। ‘আরে! কান্না থামাও’। একি! কান্নার বেগতো বাড়ছেই। হঠাৎ একটা খেয়াল চাপল মনে। পিছনের গাড়িগুলোকে বললাম আমি আস্তে আস্তে যাচ্ছি আপনারা পিছনে আসতে থাকেন। বলেই ভুস করে দিলাম টান।
রাত গভীর, রাস্তা ফাঁকা ফাঁকা। দু’চারটা বাঁক ঘুরেই কাফেলা থেকে আমি আলাদা। হায়! হায়! বরের গাড়ি হারিয়ে গেছে। ‘সবাই মোবাইল বন্ধ কর’, আমি বেশ জোরের সাথেই বললাম। নতুন বউ কেমন হকচকিয়ে গেছে, কান্নাও প্রায় নাই। মানিক মিয়া এভিনিউর পাশের ফুচকার দোকানের সামনে গাড়ী থামালাম। চলো ফুচকা খাই। বাংলাদেশের ইতিহাসে বরের গাড়ি রাত একটায় হারিয়ে গিয়ে জামাই-বউ ফুটপাতে বসে ফুচকা খাচ্ছে – এ ঘটনা কোনদিন ঘটেনি আর ঘটবেও না। তাই আসো, মনের আনন্দে ফুচকা খেয়ে নাও। বউএর কান্নাকাটি কবেই উধাও। চুক চুক করে খাচ্ছেও দেখি। একটু ভয় হচ্ছিল, গাঁ-ভর্তি গয়না, কি জানি কী হয়? দুর! এটুকু রিস্কতো নিতেই হবে। এরিমধ্যে চারপাশে লোকজন জমতে শুরু করেছে। আমি অবস্থা বেগতিক দেখে গাড়ি নিয়ে ছুট। মোবাইল চালু হবার পর ওরে বকাবকি। হু কেয়ারস।
দেশে গিয়ে সেই কাজিনটার সাথে দেখা হোল। ‘কী মনে আছে তো’? ‘মনে থাকবে না, কী যে বলেন’। ওর বউ মনে হয় একটু আবেগি, পুরোনো দৃশ্য মনে করে কেমন চোখ পিট পিট করছে। জলে ভরে উঠছে মনে হয়। আমি চলে আসি। মানুষের কান্না দেখতে ভাল লাগে না। নিজের জন্যও এক ধরনের হতাশা লাগে। আমাদের বিয়ের সময় ছিল না কোন আনুষ্ঠানিকতা, কোন আনন্দ। শুধুই অজানার আশঙ্কা, হবু বিপদের চিন্তায় কাতরতা।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৪৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/০৮/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • এম এম হোসেন ১১/০৮/২০১৭
    সুন্দর
 
Quantcast