www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

রোমান্টিক সৈকতে

হেমন্ত চলে গেছে । এ-সময় আকাশে বাতাসে হালকা শীতের ছোঁয়া । পর্যটন-প্রিয় মানুষ এ-সময়েই বেড়াতে যাবার প্লান করে । সায়ন আর সুমিত দুই বন্ধু মিলে ঠিক করল এবার দূরে কোথাও না গিয়ে তারা কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যাবে । একসাথে বেড়াতে যাবার নেশা তাদের বহু দিনের । যখন তারা দু’জনে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত সেই তখন থেকে । ব্যাচেলর দুই অভিন্ন বন্ধু অফিস থেকে ছুটি পেলেই পুরানো অভ্যাস নতুন করে ঝালিয়ে নেয় । কলকাতার কাছাকাছি দিঘা, বিষ্ণুপুর, শান্তিনিকেতন, তারাপীঠ ইত্যাদি বহু জায়গায় তারা গিয়েছে । কিন্তু পাশের রাজ্য ওড়িশার উপকূলে চাঁদিপুর আজ পর্যন্ত তাদের ঘোরা হয়নি । তাই তারা দু’জনে সিদ্ধান্ত নিল এবার তারা চাঁদিপুরেই যাবে । তারা শুনেছে চাঁদিপুরের সমুদ্র সৈকত নাকি একটু ভিন্ন স্বাদের । সকালে একরকম আবার বিকালে অন্যরকম । আর কোন চিন্তা না করে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শনিবারে তারা সকালের ধৌলি এক্সপ্রেস ধরে বালেশ্বর হয়ে সোজা চাঁদিপুর পৌঁছে গেল । আর সেখানে পৌঁছেই সমুদ্রের কাছে সুন্দর থাকার ব্যাবস্থাও করে ফেলল । লজের ফার্স্ট ফ্লোরের ডাবল-বেডেড রুম । ব্যালকনিতে দাঁড়ালে সমুদ্রের হাতছানি । নীচে রেস্টুরেন্টে সুন্দর খাবারের ব্যাবস্থা ।


ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সায়ন দেখল সমুদ্র অনেক দূরে সরে গেছে । এখানকার সমুদ্রের রূপ একটু ভিন্ন । দিঘা পুরীর মত নয়। খুব শান্ত । সকালে অনেক দূরে আবার রাতে অনেক কাছে । প্রায় আধ কিলোমিটার থেকে এক কিলোমিটার ধরে ঢেউগুলো প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে। সত্যিই প্রকৃতির এ এক অদ্ভুত খেলা । খুব অত্যুৎসায়ী ছাড়া কেউ স্নান করে না । কিন্তু সায়ন খুব হুজুকে । বয়সটাই বেড়েছে কিন্তু মনে প্রাণে সে এখনও রয়ে গেছে সেই ফার্স্ট ইয়ারে । সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসে সে সমুদ্রে স্নান করবে না এটা হতে পারে না । ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সুমিতকে চেঁচিয়ে বলে উঠল – “সুমিত রেডি হয়ে নে, সমুদ্রে স্নান করব”। ঘরের ভিতর থেকে সুমিত বলল – “আরে এই তো এসে পৌঁছালাম । পাঁচদিন থাকব । সমুদ্রে স্নান করার জন্য এত তাড়াহুড়ো কিসের ? আর তা ছাড়া এখানে ক’টা লোক স্নান করছে বল তো?” সায়ন ঘরে ঢুকে দেখল সুমিত চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে । মনে হল সকালের জার্নিতে খুব টায়ার্ড । সায়ন সুমিতের কানে দেশলায়ের কাঠি দিয়ে আলতো করে সুড়সুড়ি দিতেই সুমিত ধড়মড় করে উঠে বসল । হাসতে হাসতে সায়ন বলল – “সত্যি মাইরি তুই একদম বুড়ো হয়ে গেছিস । শিগগির রেডি হয়ে নে। আজই স্নান করব । তুই না গেলে আমি একাই যাব”। সুমিত কি আর করে ? অগত্যা সুমিতকে সায়নের সাথে যেতেই হল ।

সি-বিচের পাড় থেকে সমুদ্র অনেক দূরে । প্রায় আধ কিলোমিটার । বেশীর ভাগ পর্যটক পাড়ে বসে সমুদ্রের শোভা
উপভোগ করছে। দু-চারজন দূরে সমুদ্রে নেমে স্নান করছে । সায়ন সুমিতের হাত ধরে টানতে টানতে সি-বিচ ধরে ছুটতে লাগল । স্নান করতে নেমে সায়ন বুঝল দূর থেকে এখানকার সমুদ্রকে যতটা শান্ত মনে হয়েছিল ঠিক ততটা শান্ত নয় । সায়নের পাল্লায় পড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুমিত সমুদ্রে নেমে সমুদ্র-স্নান বেশ উপভোগ করতে লাগল । হঠাৎ মহিলা কণ্ঠের খিলখিল হাসির আওয়াজে দু’জনেই চমকে উঠল । প্রথমে মনে হল কাছাকাছি হয়তঃ কেউ স্নান করছে । কিন্তু আশেপাশে কাউকেই তারা দেখতে পেল না । যেখানে তারা স্নান করছে সেখানে তারা দু’জন ছাড়া আর কেউই নেই । তারা একটু অবাকই হল । তারা ভাবল এটা তাদের শোনার ভুল হতে পারে । ঢেউয়ের তরঙ্গে মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দেরও তো সৃষ্টি হয় । স্নান সেরে পাড়ে এসে দু’জনে ডাবের জল খেয়ে হোটেলে ফিরল । তারপর হোটেলে আর এক প্রস্থ স্নান সেরে রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ করে ঘরে এসে টানা দু’ঘণ্টা ঘুম লাগাল । বিকালে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে দু’জনে আবার বেরিয়ে পড়ল । সমুদ্রের ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারা অনেক দূরে চলে এল । ধীরে ধীরে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে সূর্যাস্তের লালচে আভায় নীলাকাশ আর সমুদ্র একাকার হয়ে গেল । কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যদেব ডুব দিলেন সাগরে । অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে । সৈকতের কাছের লজগুলোতে, ডাক বাংলোতে আলো জ্বলে উঠেছে । আকাশে একফালি চাঁদ হেসে উঠেছে । মিটি মিটি হাসতে শুরু করেছে তারাগুলো । এক সুন্দর মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে । আর নয়, এবার লজে ফেরার পালা । ফেরার সময় সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে তারা দেখল সমুদ্র গুটি গুটি পায়ে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে । আলো-আঁধারিতে সমুদ্র যেন আরও অপরূপা-রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে । সায়ন খুবই আবেগপ্রবণ । গমগমে গলায় গেয়ে উঠল – “সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা ... রঙ ছিল ফাল্গুনী হাওয়াতে” ... । সুমিত সায়নকে থামিয়ে বলে উঠল – “সায়ন প্লিজ এই গানটা গাস না । আজ পূর্ণিমা নয় । পূর্ণিমা দু’দিন আগেই চলে গিয়েছে । আর এখন ফাল্গুনী হাওয়ার রঙও ভাসছে না”। সুমিতের কথা শুনে সায়ন হো-হো করে হেসে উঠল । হঠাৎ সুন্দর একটা পারফিউমের গন্ধ নাকে আসতেই আলো-আঁধারীতে তারা দেখল ওদের পাশ কাটিয়ে এক দম্পতি বিপরিত দিকে হেঁটে যাচ্ছে । সায়ন ও সুমিত দাঁড়িয়ে পড়ল। এই আলো-আঁধারিতেও জরি-চুমকি বসানো কালো শাড়িতে মেয়েটিকে অপরূপা লাগছে । মেয়েটি ছেলেটির কোমরে হাত রেখে খিলখিল করে হাসতে হাসতে কি যেন বলে চলেছে । মেয়েটির হাসিটা সায়নের খুব চেনা লাগলো । আগে যেন কোথায় শুনেছে বলে মনে হল । সায়ন সুমিতকে বলল – “দ্যাখ ওরা কত অ্যাডভেঞ্চারাস । অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে দেখে আমরা ফিরে চলে যাচ্ছি পাড়ে আর ওরা অন্ধকারে আরও দূরে এগিয়ে যাচ্ছে”। সুমিত বলে – “নিশ্চয়ই নব-দম্পতি । তোর বিয়ে হলে তুইও ঐ রকম অ্যাডভেঞ্চেরাস হয়ে যাবি”। সুমিতের কথা শুনে সায়ন হো হো করে হাসতে লাগল ।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজনে পাড়ে চলে এল । পাড়ের বাঁধানো সিঁড়িতে বসে ঝালমুড়ি খেতে খেতে সমুদ্রের রাতের শোভা উপভোগ করতে লাগল । এই সময়ে সমুদ্রের পাড়ে অনেক লোক ।
মাঝে মাঝে ছোট ছোট বাচ্চারা খেলনা বাঁশি বাজাচ্ছে । ওদিকে ধীরে ধীরে সমুদ্র এগিয়ে এসে কখন যে পায়ের পাতা ছুঁয়ে ফেলেছে তারা খেয়ালই করেনি । এখানকার সমুদ্রের এটাই বৈশিষ্ট্য । বিকালের পর থেকে সমুদ্র আস্তে আস্তে চলে আসে পাড়ে আবার শেষ রাত থেকে সরতে সরতে সকালে অনেক দূরে চলে যায় । রাত যত বাড়তে থাকে সমুদ্রের গর্জন তত বাড়তে থাকে । সমুদ্রের শোভা দেখতে দেখতে আর দুই বন্ধু মিলে গল্প করতে করতে সময়ের কথা তাদের মাথায়ই নেই । সুমিত তার হাত ঘড়িটা দেখেই চমকে উঠল । রাত এগারোটা বেজে গেছে । সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকা লোকজন চলে গেছে । সি-বীচ একদম ফাঁকা। শুধুমাত্র তাঁরাই দু’জনে বসে আছে । আর নয় । উঠতে হবে । রাত দশটায় ডিনার শেষ হয়ে যায় । কপালে কি আছে কে জানে ? খাবার যদি না পাওয়া যায় ? তাড়াতাড়ি লজে ফিরবার জন্য সুমিত সায়নকে তাড়া লাগালো । সুমিতের কথা শুনে সায়নের খুব একটা ভালো লাগলো না । এই সুন্দর পরিবেশ তার ভীষণ ভালো লাগছে । এই মুহূর্তে তার মন এখান থেকে ছেড়ে যেতে চাইছে না । কিন্তু কিচ্ছু করার নেই । লজে ফিরতে হবে এবং ডিনার সারতে হবে । দুই বন্ধু লজের দিকে কিছুটা এগোতেই ল্যাম্প পোষ্টের আলোয় তাদের চোখে পড়ল দূরে একটা বেঞ্চিতে এক দম্পতি বসে আছে । সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তারা দু’জনে গল্প করছে । সায়ন এ-সব দৃশ্য দেখলে বেশ মজা পায় । কিছুটা দূরত্ব থাকলেও ভালো করে নিরীক্ষণ করে সায়ন দেখল সন্ধ্যের সময় তারা যে দম্পতিকে তাদের বিপরীত দিকে চলে যেতে দেখেছিল তারাই বসে আছে । সায়ন সুমিতকে এই দৃশ্য দেখিয়ে বলল – “দ্যাখ, আমরা কিন্তু এখানে একা নই । সেই দম্পতিও আছে আর দারুন এনজয় করছে”। সুমিতের তখন বেশ খিদে পেয়েছে । সায়নের কথায় বিশেষ উৎসাহ না দেখিয়ে বলল – “ওদের নিয়ে তোর এত মাথা ব্যথা কেন ? ওরা এনজয় করছে ওদের মত । পেটে ছুঁচোর ডন মারছে । চল, তাড়াতাড়ি চল”। লজে ফিরতেই ম্যানেজার ধমকে উঠে বলল – “কটা বাজে খেয়াল আছে ? রাত দশটার পর ডিনার সার্ব করা হয় না । রাত এগারোটায় মেন গেট বন্ধ হয়ে যায় । আপনারা নতুন তাই আজকের মত ডাইনিং হলে ডিনার রাখা আছে । কাল থেকে রাত দশটার মধ্যে ডিনার করে নেবেন । তারপর বাইরে গেলে পিছনের ছোট গেট ব্যবহার করবেন”। ম্যানেজারের ধমক খেয়ে সুমিত আর সায়ন মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিয়ে সোজা ডাইনিং হলে ঢুকে পড়ল ।

পরদিন ভোরে মোবাইলে দেওয়া অ্যালার্ম বাজতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল সায়ন আর সুমিতের । দাঁত ব্রাশ করে, পোশাক পালটে দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়ল । বাইরে ভীষণ কুয়াশা । স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না । এর আগে তারা এ-রকম কুয়াশা কোনদিন দেখে নি । দু’জনের কাছেই এ এক নতুন অভিজ্ঞতা । সি-বীচের দিকে যাবার রাস্তা ধরে ওরা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো । একটু এগোতেই ওরা দেখল একটা চায়ের দোকান খুলেছে । উনুনে চায়ের জল ফুটছে । দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসে চা খেয়ে ওরা আবার হাঁটতে শুরু করল । এবার একটু একটু করে কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে । দু-একটা লোক দেখা যাচ্ছে । ঝাউবনের কাছাকাছি আসতেই সায়ন বেশ অবাক হয়ে গেল । একটা ঝাউগাছের নিচে কাল রাতে দেখা সেই দম্পতি পাশাপাশি বসে আছে । মেয়েটির পরনে গত কালের সেই কালো রঙের শাড়ি । সুমিতকে দেখিয়ে সায়ন বলে উঠল – “দেখেছিস কাল সন্ধ্যায় এবং রাতে যে দম্পতিকে দেখেছিলাম তারা এখানে এখনও বসে আছে । এ-রকম প্রেমিক-প্রেমিকার মত দম্পতি কোনোদিন দেখিনি । যাবি নাকি আলাপ করতে”? সুমিতের এ-সব ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই । সে বলল – “ওরা ওদের মত আছে । পরের ব্যাপারে তোর এত মাথা ব্যথা কেন ? ওদিকে আর তাকাবি না । চল এখন দু’জনে কিছুক্ষন সমুদ্রের পাড়ে বসে সমুদ্র দেখি । তারপর সমুদ্র-স্নান করব”। সায়ন কি আর করে ? তার সাথী যখন চাইছে না তখন তাকে তার কথা মেনে নিতেই হবে । মাথা চুলকাতে চুলকাতে সায়ন সুমিতকে বলল – “ ঠিক আছে চল, তোর কথাই থাক । কিন্তু আজ নয়, কাল সমুদ্র-স্নান করব । চল আজ সাইট-সিন করে আসি”। সুমিত সায়নের কথায় সায় দিল । সি-বীচে না গিয়ে তারা আশেপাশের দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখতে বেরিয়ে পড়ল ।

চাঁদিপুরের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে এভাবেই তাদের দুটো দিন কেটে গেল । তৃতীয় দিন সন্ধ্যার পর সমুদ্রের পাড়ে ঘুরে ফিরে রাত সাড়ে নটা নাগাদ ওরা হোটেলে ফিরে এল । রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর সায়ন বায়না ধরল আরও কিছুক্ষণ সমুদ্রের হাওয়া খাবে সে । সুমিত আর বেরোতে রাজি নয় । ডিনার হয়ে গেছে । আর সারাদিন ঘুরে যা ধকল গেছে তাতে সে এখন শুতে পারলেই বাঁচে । সায়নের সমুদ্র দেখে যেন আর আঁশ মেটে না । ওর রোমান্টিক মনে শুধুই সাগরের হাতছানি । সুমিতকে হোটেলে রেখে অত্যুৎসাহী সায়ন একাই বেরিয়ে পড়ল । সমুদ্রের পাড়ে এসে একটা বেঞ্চিতে বসল । সমুদ্রের মিষ্টি হাওয়ায় তার মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেল । সে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগল । রাত বাড়ছে । সি-বীচ একেবারেই ফাঁকা । সায়নের সে দিকে কোন খেয়ালই নেই । সে একাই বিভোর হয়ে সমুদ্র দেখতে লাগল ।
-“হ্যালো” ... ?
মিষ্টি-মধুর মহিলা কণ্ঠের আওয়াজে চমকে উঠল সায়ন । পিছন ফিরে তাকাতেই সে অবাক । গত দু’দিন ধরে দেখা সেই সুন্দরী মহিলা । পরনে সেই জড়ি বোনা কালো শাড়ি । মহিলা হেসে বলল – “বসতে পারি”? সায়ন বেশ থতমত খেয়ে গেল । সমুদ্র সৈকতে জনমানব শূন্য এ-রকম পরিবেশে একা এক সুন্দরী মহিলা তার কাছে । নিজেকে সামলে নিয়ে একটু হেসে সায়ন বলল – “হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসুন । কিন্তু এত রাতে আপনি একা ?” সায়নের পাশে বসতে বসতে মহিলা বলল – “হ্যাঁ, এখন একা । একটু পরেই আমার স্বামী আসবে । আমি সামান্য আগে এসেছি । বেঞ্চিতে আপনি একা বসে আছেন দেখে আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করার ইচ্ছা হল । কলকাতা থেকে এসেছেন নিশ্চয়ই । কয়েকদিন থাকবেন তো ?” সায়ন মহিলার কথায় সায় দিয়ে বলল – “হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন । কলকাতা থেকে এসেছি । কয়েকদিন থাকার ইচ্ছা আছে”। মহিলা বলল – “আমরাও কলকাতা থেকে এসেছি । বেলগাছিয়ায় আমাদের বাড়ি”। সায়ন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল – “ও তাই ! খুব ভাল । তবে যাই বলুন না কেন প্রকৃতিকে উপভোগ করতে জানে একমাত্র বাঙালিরাই । বাঙালী ছাড়া ক’জন চাঁদিপুরের মত এ-রকম নির্জন সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসে ?” ভদ্রমহিলা সায়নের সাথে গল্প করে চলেছে আর উপভোগ করে চলেছে । সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে উদাস ভাবে ভদ্রমহিলা বলল – “ঠিকই বলেছেন । পাঁচ বছর আগে হনিমুনে আমরা এখানেই আসি । জায়গাটা এত ভালো লেগে গেল যে এখানে না এসে পারিনা । তাই প্রতি বছর এই সময়ে আমরা এখানে আসি এবং নির্জন সৈকতের সৌন্দর্য এনজয় করি । সমুদ্রটাও এখানে অদ্ভুত, তাই না ?” সায়ন মহিলার কথায় সায় দিয়ে বলল – “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন । কখনও কাছে, কখনও দূরে”। সায়নের কথা থামতে না থামতে ভদ্রমহিলা খিলখিল করে হাসতে লাগল । সে হাসি যেন আর থামে না । হাসতে হাসতেই ভদ্রমহিলা বলল – “সত্যিই খুব রহস্যময়, তাই না ?” ভদ্রমহিলার হাসিটা সায়নের কাছে বেশ অদ্ভুত লাগল । খুব অস্বস্তি হচ্ছিল তার । তার মনে হল আর এখানে থাকাটা ঠিক নয় । রাতও অনেক হয়েছে । এবার উঠতে হবে । সায়নকে চমকে দিয়ে হঠাৎ ভদ্রমহিলা বলে উঠল – “ঐ দেখুন আমার স্বামী আসছে”। একটু ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সায়ন দেখল এক ভদ্রলোক তাদের দিকে এগিয়ে আসছে । কাছাকাছি আসতেই সে দেখল গতকাল আবছা আলোয় দেখা সেই সু-পুরুষ ভদ্রলোক । পরনে পাজামা-পাঞ্জাবী । সম্ভবতঃ গতকালও এই পোশাকই সে পরেছিল । ভদ্রমহিলা তাকে দেখে খুব উচ্ছসিত হয়ে উঠল । চেঁচিয়ে বলল –“রজত এসে গেছ ?” সু-পুরুষ ভদ্রলোকটি বলে উঠল – “হ্যাঁ কমলিকা । দেখ, সমুদ্রে কি সুন্দর ঢেউ উঠেছে । আবছা চাঁদের মোহময়ী আলোয় কি অপূর্ব লাগছে । এরকমটা কোথাও পাবে ? চলনা, খানিকটা জলে নামি” । কথাগুলো বলেই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার হাত ধরে টেনে ওঠালো । উঠতে উঠতে ভদ্রমহিলা বলল –“এত রাতে জলে নামবে ? শাড়িটা যে যাবে”। ভদ্রলোক বলল –“যাক না । আবার হবে । এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ কি আর কোথাও পাব ?” এমতাবস্থায় ভদ্রমহিলা কি আর করে ! নাছোড়বান্দা স্বামীর কথায় সায় দিতেই হল তাকে – “ ঠিক আছে, চল তাই হবে”। ভদ্রমহিলা ভদ্রলোকটির কোমর জড়িয়ে ধরল । ভদ্রলোকটিও ভদ্রমহিলাকে ডান হাতে জড়িয়ে ধরল । তারপর ওরা দু’জনে ক্রমশঃ সমুদ্রের জলে নেমে যেতে লাগল । এ-দৃশ্য দেখে সায়ন খুবই অবাক হয়ে গেল । এত রাতে নির্জন সমুদ্রে তাদের কোন ভয় নেই । ওরা আরও গভীর জলে নেমে যেতে লাগল । এই মুহূর্তে সায়ন কি করবে ভেবে পায় না । শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া তার কোন উপায় নেই এখন । কারণ স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার । এদিকে সে অনেকক্ষণ সমুদ্র-সৈকতে এসেছে । অনেক রাত হয়েছে । এখন লজে ফিরতে হবে । সুমিতও হয়তঃ তার জন্য চিন্তা করছে । সে বেঞ্চি ছেড়ে উঠতে যাবে এমন সময় হঠাৎ মহিলা কণ্ঠের মর্ম-বিদারিত চিৎকার তার কানে এল – “রজত তুমি কোথায় ? কোথায় তুমি ?” সায়ন খেয়াল করল সমুদ্রের জলের মধ্য থেকে ওই মহিলা ডুকরে কেঁদে উঠছে । দূর থেকে ঠিক ঠাওর করতে না পারলেও তার মনে হল ভদ্রলোক হয়তঃ জলের স্রোতে ভেসে গিয়েছে । ভদ্রমহিলার ক্রমাগত কান্নার আওয়াজ তার কানে আসতে লাগল – “রজত তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। আমিও আসছি ......”। কিংকর্তব্যবিমুঢ় সায়ন চিৎকার করে উঠল – “বাঁচাও, বাঁচাও । কে কোথায় আছ বাঁচাও”। এই গভীর রাতে নির্জন সৈকতে তার চিৎকার শোনার কেউ নেই । তবুও “বাঁচাও ... বাঁচাও ...” চিৎকার করতে করতে সে উপরের রাস্তায় দৌড়ে উঠে এল । রাস্তার পাশেই পান-বিড়ির দোকানি দোকান বন্ধ করে দোকানের ভিতরেই ঘুমোচ্ছিল । “বাঁচাও ...বাঁচাও” চিৎকার শুনে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল । ধড়মড় করে উঠে বেরিয়ে এসে সায়নকে সে জিজ্ঞাসা করল – “কি হ’ল বাবু, অমন করে চেঁচাচ্ছেন কেন ? এত রাতে আপনি এখানে”? দোকানিকে দেখে সায়ন হাঁফাতে হাঁফাতে বলল – “এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা সমুদ্রে ডুবে গিয়েছে । আমি কি করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা । প্লিজ আপনি একটু হেল্প করবেন”। সায়নের কথা শুনে ঘুম চোখে হাই তুলতে তুলতে সে বলল – “কি বললেন বাবু, ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা ! আচ্ছা ওরা দেখতে কি খুব সুন্দর ? ভদ্রমহিলার পরনে কি কালো শাড়ি ছিল ?” দোকানির সব কথা মিলে যাচ্ছে দেখে সায়ন অবাক না হয়ে পারল না । তার মনে হল দোকানি নিশ্চয়ই অনেক আগেই দূর থেকে তাদের খেয়াল করেছিল । সে বলল – “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন । আর ভদ্রলোকের পরনে পাঞ্জাবী-পাজামা । কিন্তু এখন কি করা যায় বলুন তো ?” সায়নের কথা শুনে দোকানি কেমন যেন ম্রিয়মান হয়ে গেল । মাথা চুলকাতে চুলকাতে শান্ত স্বরে বলল – “আপনি কোন টেনশন নেবেন না বাবু । ও কিছু নয় । তাছাড়া আমাদের কিচ্ছু করার নেই । কোন হোটেলে উঠেছেন আপনি ?” দোকানির কথা শুনে সায়ন খুব রেগে গেল । যে দৃশ্য একটু আগে সে নিজের চোখে দেখেছে তাকে দোকানি বলছে কিছু করার নেই ! এ-রকম গা-ছাড়া কথায় উত্তেজিত হয়ে সে বলল –“আপনি কেমন মানুষ ? এ-রকম পরিস্থিতিতে হেল্প না করে আপনি এই ধরনের কথা বলছেন কি করে ?” এবারও দোকানি সেই আগের মতই শান্ত স্বরে সায়নকে বলল – “আপনি অত উত্তেজিত হবেন না । এ-ঘটনা নতুন নয়”। সায়ন বলল – “মানে ? কি বলছেন আপনি ?” দোকানি আবার হাই তুলতে তুলতে বলল– “সব বলছি আপনাকে । আগে বলুন এখানে কোন হোটেলে আছেন ?” সায়ন বলল – “হোটেল স্বাগতা”। দোকানি বলল – “চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি । যেতে যেতে আপনাকে ঘটনাটা বলছি”।

দোকানিটির কথাবার্তা শুনে সায়ন অবাক হয়ে গেল । এ-রকম ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সে কি বলতে চায় তা বুঝে উঠতে পারল না । দোকানিটি স্থানীয় লোক । এখানকার হাল-হকিকত সে জানে । তার উপর আস্থা রাখতেই হবে । হোটেলের পথে যেতে যেতে দোকানি সায়নকে জিজ্ঞাসা করল – “আজ কত তারিখ বলুন তো বাবু ?” সায়ন বলল – “কেন ! আজ তো নভেম্বরের ২৯ তারিখ”। এবার দোকানিটি বলতে শুরু করল – “শুনুন বাবু, আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে কলকাতা থেকে এক নতুন দম্পতি হানিমুন করতে এখানে আসে । সকালে বিকালে ওরা সমুদ্র সৈকতে খুব ঘুরত আর সমুদ্রে খুব স্নান করত । যা সাধারনত এখানে বেড়াতে আসা লোকেরা করেনা । নতুন দম্পতি বলেই হয়তঃ এভাবে তারা আনন্দ প্রকাশ করত । পাঁচ বছর আগের এই রাতে তারা সমুদ্রে নেমেছিল । এখানকার সমুদ্রের বিশেষত্ব নিশ্চয়ই জানেন । রাত যত বাড়ে সমুদ্র তত এগিয়ে আসে । সেদিন আবার জোয়ার ছিল । ওরা হয়তঃ বুঝতে পারেনি । জোয়ারের টানে দু'জনেই ডুবে যায় । পরদিন সকালে সমুদ্রের পাড়ে তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়"। দোকানির কথা শুনে সায়ন চমকে উঠল । তার শরীরের লোমকূপগুলো মুহূর্তের মধ্যে শিরশিরিয়ে খাঁড়া হয়ে উঠল । চলতে চলতে তার পা-দুটো টলতে লাগ্ল । শরীরটা এমন অবসন্ন হয়ে পড়তে লাগ্ল যে টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় বসে পড়ার মত উপক্রম হল । সায়নের অবস্থা বুঝতে পেরে দোকানি তাকে ধরে ফেলল । তাকে সান্ত্বনা দিতে দোকানি বলতে লাগল - "শুধু আপনি কেন বাবু, এর আগে এই দিনের এই বিশেষ রাতে অনেকেই এই দৃশ্য দেখেছে । এই জায়গাটা ওরা এত ভালবেসে ফেলেছে যে কিছুতেই ওরা এখানকার মায়া ত্যাগ করতে পারেনা । প্রত্যেক বছরের এই বিশেষ রাতে ওরা এখানে উপস্থিত থাকবেই । ওরা অমর । আপনি মনটাকে একটু শক্ত করুন" ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০৯৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/০২/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast