www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ডায়েরি অফ দ্য সিটি অফ ইলিউশান

পর্ব-১ঃ
(সালঃ ২০০৬-২০০৯)
শান্তিনগর কাঁচাবাজার থেকে বেড়িয়ে ডানে ফুটপাত ধরে হেঁটে চলে এলাম কনকর্ড টাওয়ারের নিচে। চৌরাস্তার মোরে এসে রাস্তাপার হয়ে আবারো ফুটপাত ধরে অগ্রসর হলাম মালিবাগের দিকে। রাত প্রায় দশটা। লোকাল বাসগুলো ঘরফেরা মানুষে ঠাসা। প্রতিদিন এই ঠাসাঠাসির মধ্যেই কোনক্রমে দরজার হ্যান্ডেল ধরে, পা-দানিতে কোনমতে জুতার আগা ঠেকিয়ে ঝুলে পড়ি। কিন্তু আজ কি যে একটা বিচ্ছিরি অবস্থা। একটা বাসও ধরা গেলোনা। আমার গন্তব্য রায়ের বাগ। সারাদিন রোদে পুড়ে শ্যাওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, দশ নম্বর, বারো নম্বরের অলিগলি হেঁটে ঘুরে পা-দুটো আর চলছিলোনা। একটার পর একটা নানা রুটের গাড়ি চলে যাচ্ছে। কোনটাতেই তিল পরিমাণ জায়গা নেই।

শরীরে ক্লান্তি, ক্ষুধার্ত পেট- দুচোখ ভেঙে রাজ্যের ঘুম। উপায়ন্তর না দেখে হাঁটতে শুরু করলাম। বামে গ্রীনলাইনের কাউন্টার রেখে সোজা চলতে লাগলাম। উদ্দেশ্য রাজারবাগ হয়ে কমলাপুর রেল স্টেশন পৌঁছে একটা উপায় বের করা। 'রায়ের বাগ' বাসস্ট্যান্ডের পাশেই, একটি পরিবারের সাথে সাবলেটে থাকি। ভীষণ সজ্জন মানুষ। কিন্তু আজকে আমার ফোনে চার্জ নেই। ব্যাটারিটা খারাপ হয়ে গেছে। পয়সাকড়ির অভাবে পালটানো যাচ্ছেনা। রাত ১১টার পরে বাসার মেইন গেইট বন্ধ হয়ে যায়। আমার ফোন বন্ধ থাকায় যাদের সঙ্গে থাকি, তাঁদেরকে ইনফর্ম করা সম্ভব হলোনা। আজ আর বাসায় ঢোকার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিনা। অবশ্য কি করে পৌঁছাবো অথবা আদৌ পৌঁছুতে পারবো কি-না কে জানে।

কমলাপুর পৌঁছুলাম যখন হাতঘড়িতে সারে এগারোটা। পথে কিছু রিকশা দেখেছিলাম। কিন্তু রিকশায় করে 'রায়ের বাগ' যাওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণে ভাড়া আমার কাছে ছিলোনা। ওদিকে সকালেই আবার বাসে চেপে মিরপুর। সারাদিনের খরচ। সেই পয়সাটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যাই হোক, প্রায় আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করার পরে একটা অনাবিল পেয়ে গেলাম। তখন টঙ্গী টু কাঁচপুর রুটের খুব পপুলার সার্ভিসগুলোর একটা। একরকম ফাঁকাই ছিলো বাসটা। হাতে গোনা কয়জন প্যাসেঞ্জার। বোধ হয় লাস্ট ট্রিপ ছিলো। জনপথ পার করতেই ঘুমে চোখ বুঁজে এলো। হটাৎই কন্ডাক্টরের হাঁক শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চেয়ে দেখি মাতুয়াইল চলে এসেছি। অর্থাৎ রায়ের বাগের পরের স্টপেজ। অগত্যা বাস থেকে নেমে, রাস্তা পার হয়ে উল্টো দিকে হাঁটা দিলাম।

চিটাগং রোড। প্রশস্ত হাইওয়ে। রাতদিন চব্বিশঘন্টাই ব্যস্ত। তারপরেও এতো রাতে হেঁটে চলার পক্ষে জায়গাটা ভালো নয়। এখানে চুরি, ছিন্তাই নিত্য দিনের ব্যাপার। অবশ্য আমার কাছে নেওয়ার মতো আছেই বা কি? তাই আর বেশি না ভেবে হাঁটতে লাগলাম। আমার প্রায় গা ঘেঁষে শাঁ-শাঁ করে চলে যাচ্ছে দূরপাল্লার বড় বড় বাস, ট্রাক, কার্গোভ্যান। হর্নের তীব্র শব্দ রাতের নিরবতা ভেঙে দিয়ে ছড়িয়ে পরে বহুদূর। হাইওয়ে থেকে বাম পাশের নিচু রাস্তায় নেমে এলাম। হাঁটছি আর দূরের বাড়িগুলো দেখছি। মধ্য রাতেও জানালায় আলো জ্বলছে। কর্মব্যস্ত মানুষেরা তাদের শান্তির নীড়ে ফিরে গেছে। খোলা জানালায় বসে ঘরকন্যায় ব্যস্ত তাদের পরিবার। হাঁটতে হাঁটতে আমার ক্লান্ত মস্তিষ্কে কল্পনায় আরও কতো কি দেখতে পেলাম। এই অসীম, বন্ধুর পথ যেন ফুরায় না। অবশেষে পৌঁছুতে পারলাম আমার বাড়ির দরজায়। আরও আধঘন্টা কলিং বেল চাপাচাপির পরে খুব বিরক্ত চোখে বাসার কেয়ার টেকার জলিল ভাই গেট খুলে দিলেন। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত দুইটা পার করেছে।

দোতলায় উঠে দরজায় নক করলাম। পারমিতা বৌদি (ছদ্মনাম) দরজা খুলে দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, "তোমরা ঘুমাও নি"? বৌদি বললেন- " তোমার ফোন বন্ধ এতো রাত হয়ে গেলো, আমরাতো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তোমার দাদা নিচে অনেক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো। আচ্ছা, টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। খেয়ে নিও।" তারপর উনি শুতে চলে গেলেন। জুতো মোজা খোলার পরে পা দুটো খুব জ্বালা করছিলো। পায়ের আঙ্গুলগুলো যেন একটার সাথে আরেকটা জোড়া লেগে গেছে। বাথরুমে যেয়ে কোনমতে স্নানটা সেরে, চারটে খেয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে পড়লাম। মানে ভাঁজ করে রাখা তোষক বালিশের উপরে শরীরটাকে একরকম ছেড়ে দিলাম।

আমার রুমে কোন খাটিয়া নেই। ফ্লোরিং করতেই ভালো লাগে। তাছাড়া একা মানুষ। এখানে ওখানে জায়গাবদলের সময় ঝামেলা কম। রুমের লাগোয়া একটা বারান্দা আছে। আশেপাশে খুব একটা উঁচু বাড়ি না থাকায়, খোলা বারান্দা দিয়ে প্রচুর বাতাস আসা-যাওয়া করে। হটাৎই একটা ঠান্ডা বাতাসের ধাক্কায় তন্দ্রা তন্দ্রা ভাবটা কেটে গেলো। উঠে গিয়ে বারান্দায় বসে একটা সিগারেট ধরালাম। ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস। হয়তো কাছেই কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। আশপাশের কোন একটা ফ্ল্যাটে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মনে হয় তারও ঘুম ভেঙে গেলো এইমাত্র। মায়ের মমতামাখা দুটি হাত তাকে পরমাদরে জড়িয়ে রেখেছে নিশ্চয়ই। এখন রাত সারে তিনটা। একটু পরেই ভোরের আলো ফুটবে। বাকি তিনঘন্টা নিশছিদ্র ঘুম। সকাল আটটায় বাসে উঠে সিট পেলে একঘন্টার একটা এনার্জি রিকভারি ঘুম।

ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। তারপরেই মনে হলো মোবাইলে চার্জ দেইনি। ওদিকে আর একজন রাত জেগে অপেক্ষা করে বসে আছেন। এতোক্ষণ ফোন বন্ধ পেয়ে নিশ্চয়ই খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। অভিমানে, ভুলবুঝে নাকের জলে চোখের জলে একাকার করে ফেলেছে। যা হয় হোক। বেঁচে থাকলে আগামীকাল সবকিছু বুঝিয়ে বলা যাবে। এখন শুধুই ঘুম। এই নিষ্প্রাণ শহরে একা এক স্বপ্নবাজ তরুণের, অমূল্য একটুকরো শান্তির ঘুম।

#চলবে

© সুব্রত ব্রহ্ম
২৫ এপ্রিল ২০২১
ময়মনসিংহ।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৫৩৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৪/০৪/২০২১

মন্তব্যসমূহ

  • মোহাম্মদ মাইনুল ১৫/০৫/২০২১
    জীবন অনেক কষ্টের। তবে কষ্টের মাঝেই সুখ আছে।
  • পড়তে থাকি।
  • অনুপম সাহিত্য কথা,
    আছে মনের ব্যথা।
    • সুব্রত ব্রহ্ম ২৫/০৪/২০২১
      আপনার বদান্যতা প্রিয় অগ্রজ। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
  • ফয়জুল মহী ২৫/০৪/২০২১
    খুবই মনোরম ভাবাবেগ।
 
Quantcast