www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

৮ ই ফাল্গুন- না ২১ শে ফেব্রুয়ারি

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ৮ ই ফাল্গুন,
আমি কি ভুলিতে পারি”- চরনটি শোনা মাত্রই
আমাদের মনে একটা প্রশ্ন এবং বিস্ময়
জাগাটা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা
আবার কি! তবে যদি বলা হয় “ আমার ভাইয়ের
রক্তে রাঙানো ২১ শে ফেব্রুয়ারি, আমি কি
ভুলিতে পারি।” তাহলে মনে হয় না, আমাদের
মত সচেতন দেশ প্রেমিক বাঙালিদের মনে
কোন সন্দেহ বা প্রশ্নের উদ্বেগ হবে। কারণ
সকলেই কাল মাত্র বিলম্ব না বুঝে ফেলবে-
এটা মহান ভাষা আন্দোলনেরই গান। তবে
আমার দ্বারা এটাই বুঝে ওঠা কষ্টকর হচ্ছে
যে- রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও
প্রমুখ বীর ভাষা সৈনিকগণ কি ৮ ই ফাল্গুন
প্রত্যাশা করেছিলেন- না ২১ ফেব্রুয়ারি?
সেই ইতিহাস বিখ্যাত ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট
গৌরবান্বিত সোনালী দিনটির কথা বলছি-
যেদিন ভারত স্বাধীনতা আইন অনুসারে লর্ড
মাউন্ট ব্যাটেন করাচিতে পাকিস্তান
ডোমিনিয়নের উদ্বোধন করলেন। কিন্তু
বিজয়ের এ আনন্দ পক্ষকালও স্থায়ী হল না
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের হৃদয়ে। কারন শুরু
হল তুমুল ভাষা বৈষম্যতা। আর এ বৈষম্যতার
স্বীকার হল পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ জনগন।
পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অফিস-আদালত,
রেল-স্টীমার, পোস্ট অফিস এবং শিক্ষা
ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে শুরু
হল উর্দুর প্রচলন। ফলে নতুন দিনের সোনালী
স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে এদেশের মানুষ
আবার জাগ্রত করে তাদের সংগ্রামী
চেতনার। আর স্বাধীনতার মাত্র ১৭ দিনের
মাথায় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর
অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেবের নেতৃত্ব জন্ম
নেয় “তমদ্দুন মজলিস” নামে একটি সংগ্রামী
সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে দিয়েই
গোড়া পত্তন হয় মহান ভাষা আন্দোলনের। আর
পাকিস্তান কায়েমের মাত্র সতের দিবসের
মাথায় প্রতিষ্ঠিত “ পাকিস্তান তমদ্দুন
মজলিস” তার জন্মের পক্ষকালের মাথায়
অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলা
ভাষার পক্ষে প্রকাশ করল “পাকিস্তানের
রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” নামক একখানা
পুস্তিকা। যার প্রস্তাব সমূহ ছিল-
১। বাংলা ভাষাই হবে:
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন (খ)
পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা,
(গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা।
২। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্র
ভাষা হবে দুটি: উর্দু ও বাংলা।
৩। (ক) বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের
শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা। ইহা পূর্ব
পাকিস্তানের শতকরা একশত জনই শিক্ষা
করবেন।
(খ) উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা বা
আন্ত:প্রাদেশিক ভাষা। (গ) ইংরেজী হবে
পূর্ব পাকিস্তানের তৃতীয় বা আন্তর্জাতিক
ভাষা।
কিন্তু আজ আমাদের ভাষা আন্দোলনের ৬২
বছর আর স্বাধীনতা সংগ্রামের ৪৩ বছর পরও
আমরা বুঝতে পারছি নাÑ “বাংলাদেশের
রাষ্ট্রভাষা বাংলা Ñ না বাংরেজী ।”
যাহোক, তমদ্দুন মজলিসের ঐ দাবী সমূহ
ধ্বনিত হওয়া মাত্রই ষড়যন্ত্র আরো গভীর হয়।
হাওয়ায় মিলিয়ে যায় লাহোর প্রস্তাবে
কায়েদে আজম জিন্নাহর দেওয়া
“পাকিস্তানের প্রত্যেক ইউনিটে
সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া
হবে” নামক এ প্রতিশ্রুতিটি। ফলে এ পূর্ব
পাকিস্তানের মানুষ হয়ে যায় স্বদেশে
পরবাসী। অনিবার্য হয়ে পড়ে অধিকার
কায়েমের আন্দোলন। যার হাত ধরে আসে
১৩৫৮ বঙ্গাব্দের মহান ৮ ই ফাল্গুন রোজ
বৃহস্পতিবার (২১ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২)।
যেদিন বাংলার ইতিহাসে কিন্তু আজ সমগ্র
বিশ্বের মাতৃভাষার ইতিহাসে ঘটে যায় এক
আলোচিত ঘটনা। এদেশের সূর্য সন্তানেরা
তাদের বুকের তাজা রক্তে ঢেলে দিয়ে নাম
লিখে ছিল তাদের মাতৃভাষা বাংলার। আর
সেই থেকেই প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য
নিয়ে ঐ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে
উদ্যাপিত হতে লাগলো। অবশেষে স্বীকৃতি
এলো ১৯৫৬ সালের সংবিধানের দ্বারা।
কিন্তু থেকে গেল আরো হাজারো
অধিকারের প্রশ্ন। আর চলতে থাকে
নিষ্পেষিত মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
অবশেষে মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে ১৯৭১।
যুদ্ধের প্রাক্কালে দেশের থমথমে
রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলার
ছাত্রলীগের এক বজ্রাদপি ডাক- “ অতীতের
সংগ্রামী প্রতিশ্রুতি নিয়ে মহান ৮ ফাল্গুন
আবার আমাদের দ্বারে সমাগত। ৮ ফাল্গুন
আমাদের জাতীয় জীবনেতিহাসে এক
যুগান্তকারী ক্রান্তিলগ্ন। বরকত, সালাম,
জব্বার, রফিক, সালাউদ্দিন এমনি একদল
অমিতেজা দু:সাহসী যুবক বুকের তাজা খুনের
বদলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি ও
মর্যাদা সুুনিশ্চিত করেছে, আজ থেকে ১৯
বছর আগে এমনি এক রক্তক্ষরা ফাল্গুনে।
সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার মর্যাদা
রক্ষার্থে এমনি আতœত্যাগের দৃষ্টান্ত আর
নেই। সেই সুমহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার
নিয়ে বাংলার ছাত্র সমাজ প্রতি বছরই এই
স্মরনীয় দিনটিতে সবাক হয়ে ওঠে। শপথ নেয়
দু:সাহসের। বজ্রকন্ঠে ঘোষনা করে, আমরা
বরকতের ভাই- আমরা সালামের ভাই। কিন্তু
মায়ের ভাষা বাংলাকে সেই ঈস্পিত
মর্যাদার আসনে সমাসীন করতে পেরেছি কি
আমরা? ৮ ফাল্গুনের অনুষ্ঠানিকতার
আতিশয্যের আড়ালে আমাদের অক্ষমতার,
আমাদের ব্যর্থতার, আমাদের হীনমন্যতার যে
কুৎসিত চিত্র মুখব্যাদান করছে, তাকে
উপেক্ষা করে এ আতœপ্রবঞ্চনা আর কতকাল
আমরা চালিয়ে যাব।”
তারপর, বাংলা ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ
ঘোষণা দেয়। এবারের ৮ ফাল্গুন উপলক্ষে
বাংলা ছাত্রলীগের কর্মসূচী:-
১৮ মাঘ (১ ফেব্রুয়ারি): বস্তী এলাকার
নিরক্ষর ছেলেমেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার
জন্য বই, খাতা, পেনন্সিল বিতরণ।
২০ মাঘ (৩ ফেব্রুয়ারি): দেয়াললিপি,
পোস্টার ও প্রচারপত্র বিলি।
২২ মাঘ (৫ ফেব্রুয়ারি): নিরক্ষর নাগরিকদের
মধ্যে ভ্রাম্যমান অবস্থায় অক্ষরজ্ঞান
প্রদান।
২৬ মাঘ (৯ ফেব্র্রুয়ারি): শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের নাম ফলক বাংলায় করার
প্রচার অভিযান।
২৭ মাঘ (১০ ফেব্রুয়ারি): এ বছর থেকেই
শিক্ষার মাধ্যম বাংলায় করার জন্য শিক্ষা
বিভাগীয় প্রধান কর্মকর্তাদের কাছে
স্মারকলিপি পেশ।
৩০ মাঘ (১৩ ফেব্রুয়ারি): অফিস আদালতের
নথিপত্র বাংলায় প্রবর্তন করার অভিযান।
১ ফাল্গুন (১৪ ফেব্রুয়ারি): বিকেল ৪টায়
রমনা পার্কে আলোচনা সভা ও গণমুখী
সাহিত্যানুষ্ঠান ও গণসঙ্গীতের আসর।
৩ ফাল্গুন (১৬ ফেব্রুয়ারি): রাস্তার মোড়ে
মোড়ে শিক্ষামূলক দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ।
৪ ফাল্গুন (১৭ ফেব্রুয়ারি): খন্ড মিছিল ও
পথসভা।
৫ ফাল্গুন( ১৮ ফেব্রুয়ারি): মধুর কেন্টিনে
কর্মী জমায়েত।
৬ ফাল্গুন (১৯ ফেব্রুয়ারি): সন্ধ্যায় সঙ্গীত
মিছিল।
৭ ফাল্গুন (২০ ফেব্রুয়ারি): বায়তুল মোকাররম
প্রাঙ্গনে বিকাল ৩:৩০ মিনিটে ছাত্র
গণজমায়েত।
৮ ফাল্গুন (২১ ফেব্রুয়ারি ফেব্রুয়ারি): ভোর
পাঁচটায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সরকারি ও
বেসরকারি ভবনে এবং সংগঠনের কার্যালয়ে
কালো পতাকা উত্তোলন, প্রভাতফেরী, ভোর
৬ টায় শহীদানদের মাজার জিয়ারত এবং
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও
শপথ গ্রহণ। বিকাল তিনটায় ঐতিহাসিক পল্টন
ময়দানে বিরাট ছাত্র জনসভা ও সন্ধ্যায় গণ-
সঙ্গীতের আসর।
এই সুমহান ব্রত নিয়ে চলা তৎকালীন বাংলা
ছাত্রলীগ আজ কোথায়! ১৯৭১ সালের ১৬ ই
ডিসেম্বর আমরা পেলাম আমাদের লালিত
স্বপ্নের বাস্তবতা, কোটি প্রাণের
আকাক্সক্ষনীয় দুর্লভ স্বাধীনতা। জয় হল
বাংলার, জয় হল বাংলার সংগ্রামী মানুষের।
কিন্তু পেলাম না আর বাংলার সেই
ছাত্রলীগ, আর সেই ৮ ফাল্গুনের কর্মসূচী এবং
তার বাস্তাবায়ন। আজ আমরা হয়তো ভুলেই
গিয়েছি- আমরা বরকতের ভাই, আমরা
সালামের ভাই। আজও আমাদের দেশের সকল
মহলেই ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়,
তা আসলে প্রকৃত কর্মসূচিই। আজও আমাদের
দেশের কবি, সাহিত্যিকগণ ২১শে ফেব্রুয়ারি
নিয়ে কবিতা, গান, গল্প, ছড়া এবং আরো কত
কিনাই যে লেখেন। নেতা- মন্ত্রীবর্গ একুশের
মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাদের গলা ফাটান। ইংলিশ
মিডিয়াম স্কুল-কলেজ গুলোতে ইংরেজীতে
লেখা কালো ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে
বক্তারা বিদেশী ভাষায় বক্তৃতা ঝাড়েন,
ছাত্ররা জানতে পারে তাদের মাতৃভাষা
বাংলা.... বাংলা....বাংলা। এদিকে ২১ শে
ফেব্রুয়ারি ঘিরে সরকারের ব্যাপক কর্মসূচী
গ্রহণ। দেয়াল, পোস্টার, ব্যানার, রাস্তা-ঘাট
থেকে শুরু করে ছোট্ট শিশুটির কোমল মুখটি
পর্যন্ত ভর্তি ২১ শে ফেব্রুয়ারি তে। অবশেষে
এক গভীর কালো রাতের নির্জনতার মাঝে
শহীদ হওয়া সূর্য সন্তানের চরনে পড়ে
সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদার শ্রদ্ধাঞ্জলী।
রাত ১২:১ মিনিট, তখনও বাংলার নির্মল
আকাশে নতুন দিনের সূর্যটি উঠতে বেশ কয়েক
প্রহর বাকী।
অন্তরালে থেকেই যায় একটি শব্দ ৮ই
ফাল্গুন..........................
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ১১৮৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/০৩/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast