www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নতুন চাকরি

এগারোটা বেজে গেছে, তবু রুমাদি অফিসে এল না। তার মানে আজ সে আর আসবেই না। অমর রক্ষিত বলে উঠল, ‘বাইরে করিডরটায় কেউ নেই। স্যারের ঘরে কেউ ঢুকে পড়লে মুশকিল হবে’। সিনিয়র টি.এ. কুসুমিতা কাঞ্জিলাল তাকে সায় দিয়ে অমিয়কে বলল, ‘অমিয়, আজ তোমায় বাইরেটায় বসতে হবে। ওখানে আজ কেউ নেই’। অমিয়র বুকটা ধক করে উঠল। দশদিনের এই চাকরিজীবনে সে যেন এই প্রথম উপলব্ধি করল তার আসল কাজটা কি। অফিসঘরের বাইরে একটা লম্বা করিডর। সেখানে লোহার বেঞ্চ পাতা আছে। অমিয় এসে বসল। কমিশনার সাহেবের ঘর পাশেই। সেই ঘর পাহারা দেওয়াটাই আপাতত তার কাজ।
যদিও অমিয় জানে যে সে এই ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের একজন এম.টি.এস মাত্র। আর এখানে এম.টি.এসের কাজ বলতে মূলত পিওনের কাজই বোঝায়। তবুও বাইরে করিডরে এভাবে একা একা বসে থাকতে বড্ড খারাপ লাগল তার। কমিশনার সাহেবের একজন পিওন আছে – রুমা লাহা, সকলের মুখে রুমাদি। বিগত ক’টা দিন পিওনের কাজ বলতে যা বোঝায় – কমিশনারের জন্য চা করা, প্লেট ধোওয়া, তার টিফিন এনে দেওয়া, ঘর পাহারা দেওয়া – সব কাজই সে একাই সামলেছে। অমিয়কে এসবের আঁচ পেতে হয়নি। সে বরং সেই সময়ে অন্যান্য কাজ করেছে। চিঠি টাইপ করে দিয়েছে। তার টাইপের হাত চালু থাকায় তাকে বকলমে একজন অস্থায়ী টাইপিস্ট হিসেবেই চালিয়ে নেওয়া গেছে। এছাড়াও সে জেরক্স করে, চিঠি ইস্যু করতে দেয়, প্রয়োজনে সেই চিঠি অন্য অফিসে পৌঁছেও দিয়েছে। কিন্তু আজ রুমাদি না আসাতেই ঘটল ছন্দপতন। তবে ছুটি তো কেউ প্রয়োজনে নিতেই পারে। সেখানে সমস্যা নয়, সমস্যা অন্য জায়গায়।
হঠাৎ বেল পড়ল। কমিশনার সাহেব তলব করেছেন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে দেখা গেল কোট প্যান্ট পরিহিত মিঃ শ্রীবাস্তব গদিচেয়ারে বসে ফাইলের কাজে বুঁদ হয়ে আছেন। খানিক বাদে তাঁর খেয়াল হল, অমিয় দাঁড়িয়ে আছে। হুকুম এল, ‘পানি কা বটল লানা হ্যায়’। অমিয় ঈষৎ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল, তারপর জল আনতে ছুটল দোতলার ক্যান্টিনে। চার বোতল জল লাগবে। ক্যান্টিনটা বেশ বড়। পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। প্রায় বারো তেরোটা টেবিল সেখানে পাতা, প্রত্যেকটাতে চারটে করে চেয়ার। লাঞ্চ ছাড়াও কাজের ফাঁকে চা খেতে খেতে গুলতানি মারবার পক্ষেও জায়গাটা বেশ। অমিয় জল আনতে গিয়ে দেখল অফিসের ইন্সপেক্টর শশীচরণ ওরফে শশীদা ওখানে আড্ডা মারছে। সঙ্গে আরো দু-তিনজন বসে। অমিয়কে দেখে সে ডাকল। জিগ্যেস করল, ‘কি রে, এখানে কি ব্যাপার?’ অমিয় তার কাছে এগিয়ে জানাল সে কি করতে এসেছে। উত্তরে শশীদা মুখ থেকে আফ্‌শোসের আওয়াজ করে বলে, ‘এঃ, তোদের দিয়ে এসব কাজ করাচ্ছে! এসব ভাল ছেলেগুলো...’ সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। পাশ থেকে আরো একজন জুড়ে দিল, ‘হ্যাঁ, অনেক নতুন নতুন ছেলেমেয়ে এম.টি.এস হিসেবে জয়েন করেছে। ভাল ভাল ডিগ্রী আছে। অথচ তাদের কাজগুলো সব ফালতু। গ্রুপ ডি’র কাজ। কিছু করারও নেই। কিছু বলতেও পারবেন না আপনি’। আরেকজন বলল, ‘আমাদের অফিসেও তো একজন এসেছে। ছেলেটা এম এ পাশ। আগে প্রাইমারী স্কুলে চাকরিও করত। সেসব ছেড়ে এখানে এসেছে। আসলে ওরা বোধহয় বুঝতেই পারেনি, এম.টি.এসের কাজটা কি? সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরি আর ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট দেখেছে, অন্য চাকরি ছেড়ে আগে এখানে এসেছে’।
অমিয়র এসব একঘেয়ে শুনতে বেশীক্ষণ ভাল লাগছিল না। সে শশীদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল। শশীদা তাকে রোজই একবার করে খোঁচা মারে যাতে সে অন্য ভাল কোন চাকরির পরীক্ষা দিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সে কাজটা যে কতটা সমস্যাসঙ্কুল সেটা তাকে বোঝানো অমিয়র পক্ষে এ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
কমিশনারকে জলের বোতল দিয়ে আবার করিডরে এসে বসল অমিয়। একা। কেউ নেই কথা বলবার, অফিসের ঘরের দরজাগুলোও সব বন্ধ। বাকী স্টাফেরা সব এসি ঘরে। কিন্তু অমিয়র ভেতরে ঢুকলে চলবে না। তাকে এভাবেই বাইরে বসে থাকতে হবে সারাটাদিন। না হলে, বেল পড়লে শুনবে কে?

* * *

অমিয়কান্তি মুখোপাধ্যায়। বাবা অনেকদিন নিখোঁজ হওয়ায় মামার বাড়ি থেকেই সে মানুষ। অবশ্য ব্যাচেলর মামার আয়ও নেহাতই যৎসামান্য। সামান্য বিজনেস করে সে। আর মা ক’টা বাচ্চাকে পড়ায়। অমিয় স্কুলে যখন পড়ত, একটা দিনও সে কামাই করত না। সে কারণে বন্ধুরা তাকে মজা করে বলত ‘বাঘের বাচ্চা’। দেড় মাইল রাস্তা হেঁটে স্কুলে যেত সে রোজ। বাসভাড়া বাঁচত তাতে। সাইকেল তো নেই। সেই অমিয় লেটার মার্কস নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে, তারপর পড়ল কেমিস্ট্রি অনার্স, পাশ করল ফার্স্ট ডিভিশনে। তাতেও ছাড়েনি সে পড়াশুনো, করেছে মাস্টার্সও। যতদিন চাকরি পায়নি, সে টিউশানি চালিয়ে গেছে। টেন, ইলেভেন, ট্যুয়েলভ। কিছু টাকা তাতে সংসারে এসেছে। কিন্তু তা সামান্যই। মায়ের তাতে বিশেষ কিছু সুরাহা হয়নি। বাচ্চা পড়িয়ে, সংসারের সমস্ত কাজ সামলে মা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ত, শরীরের যন্ত্রণায় যখন সে বিছানায় গা এলিয়ে দিত, অমিয় ভাবত যে কোন একটা চাকরি আর না জোটালেই নয়। তার নিজের জন্যেও যেমন, মায়ের জন্যেও তেমনি এই চাকরির দরকার। অবশেষে বছরখানেক চেষ্টার পর এস. এস. সির পরীক্ষা দিয়ে পেল সে এম. টি. এসের চাকরি। সেদিন মায়ের আনন্দ দেখে কে? অমিয়র মনে আছে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার যেদিন এল, মা সেদিন ফোন করে করে সমস্ত আত্মীয়স্বজনদের জানিয়েছিল তার এই চাকরি পাবার খবরটা। আর সেই লেটারের খামটা মা যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘যতদিন বাঁচব, এটা আমি আমার কাছেই রেখে দেব’।
হঠাৎ বেলটা আবার বেজে ওঠে। এবার কমিশনার সাহেব একটা ফাইল নামিয়ে দিতে বললেন আর বললেন তাঁর জন্য চা করে নিয়ে আসতে। অমিয়র ভেতরটা যেন মুষড়ে পড়তে লাগল। তবু সে বাধ্য। ফ্লাস্কে জল গরম করতে করতে তার এক-একবার মনে হচ্ছিল এ চাকরী করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে যে শিক্ষা পেয়ে এসেছে, যে পরিবেশ থেকে এসেছে – তার সঙ্গে এসব কাজ মোটেই খাপ খায় না। অফিসে চাকরি করতে এসেও যে তাকে ফাইফরমাশ খাটতে হচ্ছে এর থেকে দুঃখের আর কি হতে পারে? কিন্তু চাকরি ছাড়াটাও কি এখন এত সহজ? বিশেষত সরকারী একটা চাকরি পাওয়ার পর, তার পক্ষে কি আর আগের ঐ কষ্টকর দিনগুলোতে ইচ্ছাকৃতভাবে ফিরে যাওয়া সম্ভব?
কমিশনারকে চা করে দিল অমিয়। তাঁর চা খাওয়া হয়ে গেলে কাপ-প্লেট ধুয়ে রেখে দিল। তারপর আবার সেই নিরন্তর বসে থাকা পরবর্তী বেল পড়বার অপেক্ষায়। দুপুর দেড়টা নাগাদ কমিশনার সাহেব টিফিন করতে বসেন, তাঁর টিফিন হয়ে গেলে আবার পড়ল বেল। অমিয় ঘরে ঢুকতেই ঘরময় খাবারের একটা ভ্যাপসা গন্ধ পায়। মিঃ শ্রীবাস্তব তাঁর এঁটো টিফিনবস্কটার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ইয়ে সাফা করকে লে আও’। কমিশনারের অর্ডার শুনে অমিয় হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খেল। এটাও একটা কাজ! বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে গেল তার। কিন্তু এ কাজই যে তাকে এখন করতে হবে। জীবনে এই প্রথম তাকে অন্য কারুর এঁটো বাসন মাজতে হল।
বাথরুমে এসে সে যখন টিফিন বক্স পরিষ্কার করছিল, ঠিক সেই সময় একটা লোক হাত ধুতে এসেছিল। অমিয় নিজের কাজে ব্যস্ত থাকলেও স্পষ্টই বুঝতে পারল লোকটা তাকে দেখছে। অদ্ভুত, অবাকপারা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার মনে হল, লোকটা হাসছে, মৃদু হাসছে। কিন্তু সে হাসি সৌজন্যমূলক হাসি নয়। সে হাসি বিদ্রুপের হাসি। ঠিক যেমন তার বেশভূষা, তার পরিবেশ, তার শিক্ষা – তাকে নিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসছে, লোকটাও তেমনভাবেই যেন হাসছে। ঠিক তেমনিভাবে হাসতে হাসতেই লোকটা বেরিয়ে গেল। অমিয় টের পায় তার ভেতরে একটা উতরোল চলছে। তার সমস্ত কাজ হঠাৎ থমকে গেল। সে ইচ্ছে করল, এক্ষুণি ছুটে যেন সে পালিয়ে যায়। কিন্তু তা কি আর সম্ভব? সে যে এখন সম্পূর্ণ আবদ্ধ একটা অন্ধকূপের মধ্যে।
টিফিন বক্স পরিষ্কার করা হয়ে গেছে, সেটা স্যারের জিম্মায় রেখে এল সে। তারপর বাইরের বেঞ্চিতে নিজেকে ফেলে দিল। জীবনে এত বড় গোলামী অমিয়কে কখনও করতে হয়নি। তার প্রতিটা পদক্ষেপ এখন শ্লথ, তার সমগ্র সত্ত্ব্বা এখন আবিষ্ট – আত্মগ্লানিবোধে।
এমন সময় পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল উত্তমদা। কমিশনার সাহেবের সিনিয়র পি. এস। ‘কি ভাই, আজ তুমি একা? সব কাজ করতে হচ্ছে? রুমাদি হঠাৎ করে কামাই করল...’
- উত্তমদা শুনুন। - উত্তমদা চলে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়েই সে ডাকল।
অমিয় যেন এবার ভেঙে পড়ল, ‘আমি আর এ চাকরী করতে পারব না উত্তমদা’।
- কেন, কি হল হঠাৎ?

- নাঃ, এসব কাজ আমার পোষাচ্ছে না। আমি পারছি না, বিশ্বাস করুন, আমি এখনই এখান থেকে চলে যেতে চাই’। কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলে, ‘আমি আগে যে টিউশানি করতাম, টাকা কম হলেও সেটাই আমার ভাল ছিল।
উত্তমদা বিচক্ষণ মানুষ। আর বছর দুয়েক আছে তার অবসর নিতে। অমিয় তার কাছে পুত্রপ্রতিম। তাই সে স্নেহার্দ্র স্বরে বলতে লাগল, ‘দেখো ভাই, চাকরি ছাড়াটা কোন কাজের কথা নয়, আর এই বাজারে একটা সরকারী চাকরির মূল্য অনেক। তুমি তো নিজেও সে কথা জানো। আর তোমার এই চাকরি ছাড়া আর ভাল আয়ও কিছুই নেই। সুতরাং সেদিকটাও তো ভাবতে হবে। বাড়িতে তোমার মা আছেন, তাঁর কথাও ভাবো। আর তাছাড়া পরিশ্রম করেই তো তোমায় এই চাকরি জোটাতে হয়েছে। তারপরেও যদি সেটা হারাতে হয়, তবে সেটা খুবই দুঃখের হবে। একটু বিবেচনা করে দেখো, আমার মনে হয় না একটা চাকরি পেয়েও একেবারে সাথে সাথে ছেড়ে দেওয়াটা তোমার উচিত হবে।
- কিন্তু যেসব কাজ আমাকে করতে হচ্ছে, তা যে আমি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। আমাদের অভাব ছিল মানছি। কিন্তু আমার মা তো তাই বলে কখনো পরের বাড়ি ঝি গিরি করতে যায়নি। সেও পড়াত। হয়ত তাতে টাকা এমন কিছু বেশি আসত না, কিন্তু সম্মান? তাকে আপনি অস্বীকার করবেন কি করে? আর আমিও যে এই পরিবেশেই মানুষ হয়েছি উত্তমদা।
উত্তমদা অমিয়র কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিল। তারপর বলল, ‘সবই বুঝলাম, তবু বলব চাকরি ছাড়াটা ঠিক নয়। এতে পলায়নী মনোবৃত্তিও কাজ করে। কেন তাকে প্রশ্রয় দেবে? তার চেয়ে বরং ভাল চাকরির পরীক্ষা দিয়ে অন্য চাকরি পেয়ে তারপর এই চাকরি ছাড়ো। তাতে লাভ অনেক বেশি’। এই বলে কিছুটা থেমে সে আবার জুড়ে দিল, ‘আর দু-একদিন এইসব কাজ আমাদেরও করতে হয়েছে। এমনও একদিন গেছে, স্যারের ঘরে মিটিং চলছে, আমি চা সার্ভ করছি, শশী বিস্কুট দিচ্ছে। সুতরাং এই নিয়ে ঘাবড়াবার দরকার নেই’।
কথাগুলো বলে উত্তমদা চলে গেল। আর করিডরে বসে অমিয় ভাবতে থাকে, সত্যিই কি ঘাবড়াবার দরকার নেই? যেগুলো সে ভেবেছে তা নিছকই ভুল? নিজের মনগড়া মিথ্যে গুমর?
হঠাৎ সে দেখতে পেল উত্তমদা আবার ফিরে আসছে। হঠাৎ সে অমিয়র দিকে আঙুল তুলে কি যেন ইঙ্গিত করতে চাইল। মুখে তার ফুটে উঠল হাসি – সেই হাসি যা সে দেখেছিল বাথরুমে সেই লোকটার ঠোঁটে। হঠাৎ পাশের অফিসঘরগুলোর দরজা খুলে গেল। সেখান থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে লাগল শশীদা, সুপর্ণাদি, কুসুমিতাদি, অমরদা, শ্যামদা, অনুপমদা – সমস্ত স্টাফেরা। তাদের সকলেরই মুখে সেই একই বিদ্রুপাত্মক হাসি। তারা এখন আর মুখ টিপে হাসছে না। তারা জোরে হাসছে, হাঃ হাঃ করে হাসছে আর তাকে ক্রমাগত আঙুল তুলে ইঙ্গিত করছে, অমিয় এদের দেখে ঘাবড়ে গেল, সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আর ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সবাই তার দিকেই এগোতে লাগল বড় অদ্ভুতভাবে, হাসতে হাসতে, ইঙ্গিত করতে করতে। অমিয় উপায়ান্তর না দেখে পালাতে চাইল সেখান থেকে। কিন্তু সকলে যে তাকে ততক্ষণে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে, আরো ঘিরে ধরছে। সে আকুল স্বরে চীৎকার করতে লাগল, আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও’। কিন্তু তার গলা থেকে একটুও আওয়াজ বেরোল না।
‘কি হয়েছে ভাই, শরীর খারাপ লাগছে?’ উত্তমদার কথায় অমিয়র যেন হুঁশ ফিরল। সে স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ উত্তমদার দিকে চেয়ে রইল। তারপর চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, কই, কেউ তো নেই এখানে! সব অফিসঘরই তো বন্ধ। ঠিক যেমনটা আগে ছিল, তেমনই রয়েছে। এ তার সাথে তবে কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে এসব? তার একেবারে অসহ্য লাগল। তার কপাল থেকে অবিরল ঘাম ঝরছে, পকেট থেকে সে রুমাল বার করল ঘাম মোছবার জন্য। উত্তমদাকে জানিয়ে দিল, চিন্তার কিছু নেই। সে ভালই আছে।
সেদিন দু-একটা ফাইল এ ঘর থেকে ও ঘর আনা নেওয়া ছাড়া আর বিশেষ একটা কাজ কিছু ছিল না। ছুটির সময় পড়ল আবার ডাক। এবার কমিশনার বললেন, তাঁর ব্যাগটা নিয়ে তাঁর গাড়িতে রেখে দিয়ে আসতে হবে।

* * *
বাড়ি ফিরতে ফিরতেই অমিয় মনস্থ করে ফেলল আর একদিনও সে এ চাকরি করবে না। কালই সে রেজিগনেশন দেবার জন্য যা করতে হয়, তা জেনে নেবে এবং সেইমত কাজ শুরু করবে। তবে মায়ের সাথে পরামর্শ না করে তো আর কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। মা আর মামা – দুজনকেই সব জানাতে হবে। তবে মায়ের সম্মতি পাওয়াটা খুব একটা অসুবিধা হবে বলে তার মনে হল না। একটু চাপ দিলেই, একটু অনুনয় করে বললেই মা সবটা বুঝতে পারবে। আর মামাও নিতান্ত ভাল মানুষ, সাদামাটা গোছের। তবু তাকে বোঝাতে অমিয় যদি সফল নাও হয়, মায়ের কথা মামা ফেলতে পারবে না। ফলে মামাকে বোঝানোটাও বিশেষ সমস্যা হবে না।
সেদিন অমিয় বাড়ি ফিরল রাত সোয়া আটটায়। বাড়িতে এসেছে পাশের বাড়ির আরতিকাকিমা। মায়ের পাড়াতুতো বন্ধু। প্রায়ই সে আসে মায়ের সাথে গল্প করতে। তবে বড্ড বেশি পিএনপিসি করে বলে অমিয়র তাকে বড় একটা ভাল লাগে না। আরতি কাকিমা অমিয়কে ফিরতে দেখে হাসিমুখে জিগ্যেস করল, ‘কি রে অমিয়, অফিস থেকে এই ফিরলি বুঝি?’ অমিয় মৃদু হাসি টেনে বলে, ‘হ্যাঁ, এই সময়েই তো ফিরি’। কাকিমা বলে, ‘তা বাবা, নতুন চাকরি কেমন লাগছে?’ প্রশ্ন শুনে অমিয়র প্রথমটায় বিরক্তি লাগে, তারপর সেটা ঢাকতে ম্লান হাসবার চেষ্টা করে ঘাড় নেড়ে জানায়, ‘ভাল’। তারপর সে পাশের ঘরে চলে যায়। ঘরটা অন্ধকার। সে আলো না জ্বেলেই অফিসের ব্যাগটাকে ঘরের একপাশে ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। শুনতে পায়, আরতিকাকিমা মাকে জিগ্যেস করছে, ‘তোমার ছেলের অফিসে কাজের চাপ কেমন গো?’
মা বলে, ‘কাজের চাপ তো তেমন কিছুই নেই। ঐ কয়েকটা চিঠি টাইপ করতে হয়, ব্যস এই অব্দিই’।
- যাক, তাহলে ভাল। আমারটা যে কবে একটা চাকরি জোটাবে। আসলে কি জানো তো, ওর মাথা আছে, অথচ কিছুতে মন দিয়ে পড়বে না। এই হল সমস্যা। আর আজকের দিনে যা কম্পিটিশন। তাতে মন দিয়ে না পড়ে কি আর ভাল চাকরি পাওয়া যায়?
মা তাতে সায় দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, সেই তো। চাকরি পেতেও এখন অনেক পরিশ্রম করতে হয়। আমার ছেলেও তো একবছর চাকরির জন্য চেষ্টা করেছে, তবে পেয়েছে। এতদিন শুধু টিউশানি করত বলে লোকে নানা কথা বলত, ‘কত আয় হয়’, ‘তোদের চলে কি করে’, ‘কিভাবে চালাবি সংসার’। যাক, এখন তো সেসব বলতে পারবে না। এখন আমি গর্ব করে বলতে পারব, ছেলে আমার সরকারী চাকরি করে।....

মা হয়ত আরো কিছু বলছিল। অমিয় আর থাকতে পারল না। বিছানা ছেড়ে উঠে সে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। মায়ের কথা এখন আর শোনা যাচ্ছে না। এটাই একটা স্বান্ত্বনা। একটা দীর্ঘশ্বাস। আর ঘরময় সব অন্ধকার। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। অমিয় বুঝে নিল, তার গোপন দুঃখের একমাত্র সাক্ষী হিসেবে কেবল এই অন্ধকারটুকুই পড়ে রয়েছে।
:: সমাপ্ত ::
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৬৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১১/০৬/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast